ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আজ শেষ বর্তমান ইসির মেয়াদ: সাফল্য কেবল ৭ সিটি নির্বাচনে

ecডেস্ক নিউজ:
২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেওয়া কাজী রকিব উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি)। নানা আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে পাঁচ বছরের মেয়াদ পার করল দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সার্চ কমিটির সুপারিশে গঠিত এই কমিশন। সংখ্যার বিচারে বিদায়ী কমিশন সব থেকে বেশিসংখ্যক নির্বাচনের আয়োজন করেছে। এ কমিশন প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনও আয়োজন করেছে। এছাড়া দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে এই কমিশনের অধীনেই।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে বিদায়ী কমিশনের সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ছিল ভারি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক ছিল সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। বিদায়ী নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি, পারেনি এই নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করতেও। জাতীয় সংসদের তিনশ আসনের অর্ধেকেরও বেশি আসনের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়া আসনগুলোতেও ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম।

তবে সাতটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনে সফল ছিল বিদায়ী এই কমিশনের সদস্যরা। এ কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে। সর্বশেষ গত বছরের ২২ ডিসেম্বর দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনও শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। কমিশনের মেয়াদের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি নির্বাচন নিয়েও সন্তুষ্টি ছিল সবার। তবে, গত ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়।

কমিশনের মেয়াদকালের কার্যক্রম পর্যলোচনা করলে দেখা যায়, মেয়াদের প্রথম দুই বছর ভালোভাবে কাটাতে সমর্থ হয় কমিশন। তাদের নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে ব্যর্থ হয় ইসি। ওই নির্বাচনে তিনশ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন প্রার্থীরা, যাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় নির্বাচনটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল বলে সিইসি কাজী রকিব ওই সময় দাবি করেন।

জাতীয় নির্বাচনের পরপরই অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ছয়টি ধাপে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের প্রথম দুইটি ধাপ কিছুটা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হলেও শেষদিকে সহিংসতা ও অনিয়মের মাত্রা বাড়তে থাকে। উপজেলার পর গত দুই বছরে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অনিয়মের অভিযোগ ছিল। ওই তিন সিটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী দিলেও ভোটের দিন তারা বর্জন করে। এরপর অনুষ্ঠিত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ব্যাপক সংহিসতা ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল। এ দু’টি নির্বাচনে অনেক জায়গায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রও জমা দিতে পারেনি। অনেক জায়গায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনিয়মে অংশ নেন। কিন্তু কমিশনের পক্ষ থেকে এসব অনিয়ম প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

উপজেলা নির্বাচনের পর বিরোধী দলসহ সমালোচকদের অনেকে বর্তমান কমিশনকে ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। এ বিষয়ে নিজেদের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে গিয়ে কমিশনার জাবেদ আলী টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কোমর দুলিয়ে বলেছিলেন, ‘মেরুদণ্ড তো ঠিকই আছে।’

পৌরসভা নির্বাচনে অভিযোগ উঠেছিল, নির্বাচনে পুলিশ বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না। এ বিষয়ে কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একাধিক চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী অন্য কমিশনারদের পরামর্শ উপেক্ষা করে পুলিশ সদর দফতরে গিয়ে নির্বাচনে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। এ ঘটনায় অন্য কমিশনাররা ক্ষুব্ধ হন। তাদের মতে, জাবেদ আলীর এই ভূমিকা কমিশনের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।

এদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে একজন পুলিশ সুপারকে বদলির নির্দেশ দিয়েছিল কমিশন। ইসির নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার ওই কর্মকর্তাকে বদলি করলেও নির্বাচনের সময় তিনি আবার ওই একই জেলায় ফেরত আসেন। এতে ইসির ক্ষমতা ও ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এছাড়া কমিশন চাঁদপুরের একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করায় আদালতে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়।

বর্তমান কমিশন নিয়ে এই মুহূর্তে প্রতিক্রিয়া জানাতে চান না সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘কমিশন দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোনও কথা বলতে চাই না। আগে তাদের দায়িত্বটা শেষ হোক, পরে তাদের মূল্যায়ন করব। তবে এই কমিশন যে তার মেয়াদ শেষ করতে পেরেছে, সেটা অনেক বড় বিষয়।’

সাবেক কমিশনার ছহুল হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই কমিশন নিয়ে কথা বলতে গেলে সেটা তুলনামূলক হয়ে যাবে। এতে করে অনেকে পক্ষপাতদুষ্ট মনে করতে পারেন। এর থেকে অন্য কাউকে দিয়ে মূল্যায়ন করলে আসল চিত্র জানা যাবে। আমরা কতটা করতে পেরেছি আর এই কমিশন কতটা পেরেছে, সবাই তার তুলনা করতে পারবেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘এই কমিশনের বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে যে, কমিশন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। কমিশনের প্রতি যে প্রতাশ্যা ছিল, তা তারা পূরণ করতে পারেনি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে আস্থায় নিতে পারেনি। সরকারি দলের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেছে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত এই রকিব কমিশনের কাছে জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিল। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমি মনে করি, এই কমিশন যে ত্রুটির জন্ম দিয়ে গেলেন, নতুন কমিশন তা উত্তরণে সক্ষম হবেন।’

নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই কমিশন আমাদের ‍পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।’

নির্দেশনা অমান্য করায় সম্প্রতি আদালতে কমিশনের মাফ চাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে ড. মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন তাদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার জন্য আদালতে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার জন্য জাতির সামনে তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।’

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদদের (জানিপপ) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে সম্ভবপর সব চেষ্টাই করেছে। তবে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময় অতিক্রম করতে গিয়ে তাদের শতভাগ সফল হওয়ার সুযোগ ছিল না। সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। তবে তাদের পুরোপুরি সফল বলার কোনও সুযোগ নেই।’

নির্বাচন কমিশন অবশ্য বরাবরই নিজেদের সফল দাবি করেছে। গত মাসে কুমিল্লা আঞ্চলিক সার্ভার স্টেশন উদ্বোধনকালে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের পাঁচ বছর মেয়াদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, পাঁচ বছরে তাদের কোনও ব্যর্থতা নেই। প্রতিটি নির্বাচন তারা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের সাফল্যের সবকিছু রেকর্ডে আছে বলেও তিনি দাবি করেন।

মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে গিয়েও কমিশন নিজেদের সফল দাবি করেন। সাক্ষাতে সিইসির বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাক্ষাতের সময় সিইসি বলেছেন, তাদের মেয়াদে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।’ এর আগে গত রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতেও সিইসি একই দাবি করেন।

বুধবার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন সিইসি

বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিরউদ্দিন আহমদ বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) এসএম আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, দুপুর আড়াইটায় নির্বাচন কমিশন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন সিইসি।

পাঠকের মতামত: