ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

বাৎসরিক ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ইলিশ আহরন, প্রেক্ষিত কক্সবাজার

hilsha1_240038আতিকুর রহমান মানিক:
কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ক্রমশঃ বাড়ছে ইলিশ উৎপাদন। এখন ইলিশ মৌসূম না হলেও জেলার হাটবাজারে ইলিশের সরবরাহের কমতি নেই (যদিও সাইজ একটু ছোট)। ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারগৃহীত কর্মসূচী গত কয়েকবছর ধরে কক্সবাজারে কঠোরভাবে পালিত হয়েছে। ইলিশ প্রজনন মৌসূমে সরকারী নিষোধাজ্ঞা মান্য করে ফিশিংবোট মালিক-শ্রমিকরা সাগরে বোট পাঠাননি, ববফকল মালিকরা বরফকল বন্ধ রেখেছেন, ব্যবসায়ী, সরবরাহকারী ও আড়তদাররা ইলিশ ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড নিরলস কাজ করেছে উপরোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়নে। আর কক্সবাজার মৎস্য অধিদপ্তর “ঈগল দৃষ্টি” রেখে সমন্বয় করেছে সবকিছু। ফলে প্রতি বছর অক্টোবর- নভেম্বরে প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সাগর ও নদী মোহনায় পর্যাপ্ত ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। জেলায় বেড়েছে ইলিশ মাছের উৎপাদন, আহরন ও সরবরাহ। দেশের ৪ টি প্রধান ইলিশ প্রজনন এলাকার একটি “গন্ডামারা” কুতুবদিয়া দ্বীপের অদুরে বঙ্গেপসাগরে অবস্হিত। গত কয়েকবছর ধরে নির্বিঘ্ন প্রজননের ফলে উৎপাদন, আহরন ও সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইলিশ মাছের জন্য প্রসিদ্ধ কক্সবাজার আবারো ফিরে পাচ্ছে আগের ঐতিহ্য।
একই সাথে জাতীয়ভাবেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে ইলিশের বাণিজ্য। গত বছর ৪ লাখ টন ইলিশ আহরণের কর্মসূচি পালন করেছিল সরকার। ইতিমধ্যেই তা ছাড়িয়ে গেছে। মৎস্য অধিদফতর ধারণা করছে, বছর শেষে আহরন সাড়ে ৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে প্রকাশ, ইলিশ উৎপাদনে গত ১৮ বছরের মধ্যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ১৯৯৮ সালে দেশে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়েছিল। ফলে বিশ্লেষকদের ধারণা চলতি বছরে ইলিশের বাণিজ্য ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। উৎপাদন বেশি হওয়ায় দামও নাগালের মধ্যে।
ফলে সাধারণ মানুষও কিনতে পারছে। একই সঙ্গে বিশ্বে দেশের ইলিশের নতুন বাজার তৈরির সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। অন্যান্য রপ্তানী পন্যের মত ইলিশ মাছেরও ব্র্যান্ডিং হয়তে আর বেশী দুরে নয়। এদিকে ইলিশের কারণে বাজারে অন্যান্য মাছের দামও কম।
মৎস্য অধিদফতরীয় সূত্রের মতে, সরকারের পরিকল্পিত কর্মসূচির কারণেই ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। বছর শেষে তা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। এ সময় মৎস্য অধিদপ্তরীয় কর্মকর্তারা এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায়। আর এ কর্মসূচি সঠিকভাবে পালন হওয়ায় এ বছর ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে।
ইলিশ পাওয়া যায় বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতেই উৎপাদন কমছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিবছর উৎপাদন প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়।
এর ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে। অন্যদিকে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১৫ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) এ খাতের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। সূত্র আরও জানায়, গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ইলিশের উৎপাদন ৩ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে উঠানামা করছে।
এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টনে। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো। কিন্তু বছরে তা সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রচলিত বাজার মূল্যে প্রতিকেজির দাম কম করে ৬৫০ টাকা ধরা হলেও সংগৃহীত সাড়ে ৪ লাখ টন ইলিশের সার্বিক বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষক ড. আনিসুর রহমানের মতে স্বাভাবিকভাবেই ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। মূলত জাটকা নিধন ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ এবং মাছের অভয়ারণ্য বাস্তবায়নের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, মা ইলিশ ও ডিম বাড়ছে, মাছও বাড়ছে। ২০০৯ সালে সাগর-নদী উপকূলীয় এলাকা চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও পটুয়াখালীর ২১ উপজেলায় জাটকা নিধন বন্ধ, মা ইলিশ রক্ষা ও ইলিশের বংশবিস্তারের জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। পরবর্তী সময়ে এ কর্মসূচি ছড়িয়ে দেয়া হয় দেশের ২৫ জেলায়। তার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমানে সারা দেশে ইলিশ মিলছে। আর দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। বড় আকারের প্রতি হালি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায়। এ ছাড়া মাঝারি আকারের হালি প্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে। ছোট ইলিশ বা জাটকা বিক্রি হচ্ছে হালি প্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়।
দেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। দেশের মোট মাছের প্রায় ১৫ শতাংশের উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে। ইলিশ রফতানি করে ৪০০ কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। এ ছাড়া প্রায় ৫ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি জড়িত। পরোক্ষভাবে ২০-২৫ লাখ লোক পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানি ইত্যাদি কাজে জড়িত।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ও মৎস্যবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ইলিশ নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। মাছ সংরক্ষণ করা যাবে না। নদীগুলো ইলিশ উপযোগী কি না বা মাছ সংরক্ষণ মৌসুম কতদিন রাখতে হবে, সেটি জানতে গবেষণা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সরকার যে অভয়াশ্রমের কথা বলছে, সেটিও কতদিন রাখা যাবে তাও অনিশ্চিত। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার যে কয়দিন মাছ ধরা বন্ধ করছে, সে সময়েই ইলিশ সর্বোচ্চ ডিম দেয় কি না, তা জানা নেই। তাই কখন ইলিশ প্রচুর ঢুকছে সেটি জেনে কর্মসূচি নিতে হবে। পানি প্রস্তুত কি না- সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।
পরিশেষে বলতেই হয়, সরকারগৃহীত যুগউপযোগী পদক্ষেপের ফলে এখন ইলিশ মাছ সহজলভ্য। কক্সবাজারের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে ইলিশ। এখানে ফিশিংবোট, বরফকল, পেট্রোল পাম্প, ড্রাইডক, কোল্ড স্টোরেজ, পরিবহন ও শুঁটকিসহ অন্যান্য সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে ইলিশ আহরন এবং বিপননকে কেন্দ্র করে। এর ফলে জেলার ব্যাংকিং খাত চাঙ্গা হচ্ছে। একই সাথে বাড়ছে কর্মসংস্হান, কমছে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য। ইলিশের জন্য বিখ্যাত কক্সবাজার আবারো ফিরে পাচ্ছে পুরানো তকমা। সমুদ্র দর্শন ও ঘুরাঘুরির পাশাপাশি দেশী-বিদেশী পর্যটকরা টাটকা ইলিশ মাছের স্বাদ নেয়ার জন্যও কক্সবাজারে আসবেন, এই হোক আগামীর প্রত্যাশা।
আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট
চীফ রিপোর্টার,
দৈনিক আমাদের কক্সবাজার।
মুঠোফোন, ০১৮১৮-০০০২২০

পাঠকের মতামত: