ঢাকা,বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

পিতার কষ্টগাঁথা, ঠিক যেন আরেক ‘আয়লান’

অনলাইন ডেস্ক ::::

দুটি ছবি প্রায় একই রকম। একটি ছবি আয়লান কুর্দির। অন্যটি মোহাম্মদ শোহায়েত নামের ১৬ মাস বয়সী শিশুর। আয়লান কুর্দির ছবি বিশ্ব মানবতাকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু শোহায়েতের ছবিও মানুষকে কাঁদিয়েছে। প্রথমে সামাজিক মিডিয়ায় তার ছবি ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দাবি করা হয় এ ছবিটি রোহিঙ্গা শিশুর। কিন্তু নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছিল না নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে। এখন এ শিশুটির পরিচয় পাওয়া গেছে। সে সত্যি এক রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারের সন্তান। তার পিতারrohingya নাম জাফর আলম। তিনি নিশ্চিত করেছেন শোহায়েত তার সন্তান। বর্ণনা করেছেন কিভানে নাফ নদী পাড়ি দেয়ার সময় শোহায়েত ও তার স্ত্রীর সলিল সমাধি হয়েছে। এ নিয়ে বিস্তারিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অনলাইন সিএনএন। এতে মোহাম্মদ শোহায়েত সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবেÑ মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে একটি ছোট্ট শিশু। তাকে পানির ¯্রােত ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে তীরে। তার নাম মোহাম্মদ শোহায়েত। বয়স ১৬ মাস। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা থেকে তার পরিবার পালিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার মা, এক চাচা ও তিন বছর বয়সী আরেক ভাইসহ নদীতে ডুবে মারা গেছে। জাফর আলম সিএনএনকে বলেছেন, যখন আমি শোহায়েতের ওভাবে তীরে পড়ে থাকা ছবি দেখতে পাই আমার মনে হয়েছিল এর চেয়ে আমার মরে যাওয়া ভাল। এই দুনিয়ায় আমার আর বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তুরস্কের সমুদ্র সৈকত থেকে উদ্ধার করা হয় সিরিয়ার শরণার্থী শিশু আয়লান কুর্দির মৃতদেহ। সেও নিজের দেশের গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য পরিবারের সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তার ছবির সঙ্গে শোহায়েতের ছবি সমান্তরালে বিবেচনা করা হচ্ছে। আয়লান ও শোহায়েত দু’জনে দেশ ছেড়েছিল যে কারণে তা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু দুটি পরিবার যেভাবে পালাচ্ছিল তা একই রকম। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের মনে করা হয় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার যেসব সংখ্যালঘু তার অন্যতম। রোহিঙ্গারা রাখাইনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসবাস করলেও মিয়ানমার সরকার তাদেরকে বাঙালি হিসেবে অভিহিত করে। জাফর আলম বলেছেন, রাখাইনে আমাদের গ্রামে আমাদের ওপরে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়। মিয়ানমারের সেনারাও আমাদের ওপর প্রকাশ্যে গুলি করেছে। এর ফলে আমরা বাড়িঘরে থাকতে পারছিলাম না। আমাদেরকে পালাতে হয়েছে। পালিয়ে জঙ্গলে আ¤্রয় নিয়েছি। আমার দাদা-দাদীকে তারা পুড়িয়ে মেরেছে। পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে সেনারা। এখন সেখানে কিছুই নেই। আমাদেরকে জীবন বাঁচাতে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।
জাফর আলম বলেন, আমি ৬ দিন ধরে হেঁটেছি। চারদিন পেটে কোনো দানাপানি পড়ে নি। ওই ৬দিন আমি ঘুমাতে পারি নি। এ সময়ে অব্যাহতভাবে আমাদেরকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পালাতে হয়েছে। কিন্তু চলার পথে আলম এক পর্যায়ে তার পরিবার থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। তিনি নাফ নদী দিয়ে পালিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশে। এই নদীতে সাঁতার কেটে তিনি পালানোর চেষ্টা করেন। তাকে দেখে বাংলাদেশের জেলেরা উদ্ধার করে তীরে নিয়ে আসেন। এরপরই তিনি পরিবারের অন্যদের নিরাপদে বাংলাদেশে আনার চেষ্টা করতে থাকেন। জাফর আলম বলেন, আমি একজন মাঝির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাকে বলি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের নিরাপদে নদী পাড় করে দিতে। সর্বশেষ ৪ঠা ডিসেম্বর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা মিয়ানমার ছাড়তে বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল। সেই ছিল পরিবারের সঙ্গে আমার শেষ কথা। আমি যখন টেলিফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন ছোট্ট ছেলের ‘আব্বা আব্বা’ ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। এই ফোনকলের মাত্র কয়েক ঘন্টা পরই আমার পরিবার পালানোর চেষ্টা করে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষীরা যখন এটা টের পেয়ে যায় তখন তারা গুলি শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে মাঝি নৌকার সবাইকে গুলির হাত থেকে জীবন বাঁচানোর আহ্বান জানান। নৌকাটিতে ছিল অতিরিক্ত মানুষ। তারা নড়াচড়া শুরু করায় নৌকাটি ডুবে যায়। একদিন পরেই ৫ই ডিসেম্বর আমি জানতে পারি কি ভয়াবহ এক ঘটনা ঘটে গেছে আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জীবনে। জাফর আলম আরও বলেন, কেউ একজন আমাকে ফোন করেন। বলেন, আমার ছেলের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তিনি আমার ছেলের একটি ছবি তুলেছেন মোবাইল ফোনে। তা পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাকে। তা দেখে আমি যেন বোবা হয়ে পড়েছিলাম। সেই স্মৃতি হাতড়ে জাফর আলম বলেন, আমার ছেলের সম্পর্কে কোনো কথা বলা খুবই কঠিন। সে আমার খুবই প্রিয় ছিল। আমাকে ভীষণ ভালবাসতো। সে সবার আদরের ছিল। গ্রামের সবাই তাকে ভালবাসতো।

পাঠকের মতামত: