ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

এক গ্রামে ১৪ ইটভাটা!

ফটিকছড়ির পাইন্দং গ্রামের ফকিরা চানপাড়া। এই পাড়ায় ফসলি জমিতে পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে দুটি ইটভাটা। সমানে পোড়ানো হচ্ছে ইট। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশ। অথচ ইটভাটা ঘেঁষেই রয়েছে কমপক্ষে ৫০টি বসতঘর। দুটি ইটভাটার দূরত্ব সর্বোচ্চ ৫০০ গজ।
শুধু ফকিরা চানপাড়া নয়, পুরো গ্রামই যেন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে মোট ১৪টি ইটভাটা।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকা ও কৃষিজমির এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা নিষিদ্ধ। অথচ পাইন্দং গ্রামে বসতবাড়ির পাশে এবং ফসলি জমির ওপর এসব ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রায় ২৫ বছর আগে এই গ্রামে প্রথমে একটি ইটভাটা নির্মাণ করা হয়। এরপর বছরান্তে বাড়তে থাকে এই সংখ্যা। এখন দাঁড়িয়েছে ১৪টিতে। এসব ভাটা গড়ে ওঠায় এলাকার ফসলি জমি ও উৎপাদন কমেছে। অন্যদিকে ইটভাটার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে গ্রামের মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক এবং গহিরা-হেঁয়াকো সড়কের পাশে পাইন্দং গ্রামে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো হলো এবি, পিবি, এমবি, এফবি, এইচআরবি, এসবি, এএমবি, জেবি, আরকে, বিএম, এসবি, আরবিএম, কেবিএম ও পিটিবি। প্রতিটি ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে ফসলি জমিতে। পাশের জমি থেকেই এসব ভাটায় মাটির জোগান আসে। এ কারণে ভাটাগুলোর চারপাশে জমিতে অসংখ্য ছোট-বড় ডোবার সৃষ্টি হয়েছে।
পাইন্দং গ্রামের বাসিন্দা ও ফকিরা চান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল উদ্দিন বলেন, ধোঁয়ার কারণে নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
ফকিরা চানপাড়ার বাসিন্দা গৃহবধূ শিরীন আকতার বলেন, ইট পোড়ানো শুরু হলেই সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয়। শিশু ও বৃদ্ধদের এ সমস্যা বেশি হয়।
এ প্রসঙ্গে নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপিকা মুশফিকা চৌধুরী বলেন, ‘ইটভাটার কালো ধোঁয়ার সঙ্গে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’
ফটিকছড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা এইচ এস রাশেদুল আলম বলেন, ‘কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়, যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এবং হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।’
এদিকে কমছে কৃষিতে উৎপাদনও। গ্রামের কৃষক মুহাম্মদ আবদুল মুনাফ বলেন, ‘ইটভাটার কারণে ফসলের আবাদ কমে গেছে। আগে এক কানিতে প্রায় ১০০ আড়ি ধান হতো। ভাটাগুলো নির্মাণের পর ৪০ থেকে ৫০ আড়ির বেশি ধান পাওয়া যায় না।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লিটন দেবনাথ বলেন, ‘ফসলি জমিতেই গড়ে উঠেছে ইটভাটাগুলো। ভাটার কালো ধোঁয়ায় মৌমাছি আসতে পারে না। এ জন্য পরাগায়নে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ফসলের ফলন ভালো হয় না। দিন দিন শাকসবজি ও ফলমূলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।’ পাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি মাসিক সমন্বয় সভায় কয়েকবার উত্থাপন করা হয়। ইটভাটার কারণে পরিবেশের ক্ষতি ও গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা যে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন সেই ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়। কিন্তু এসব ইটভাটা বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি ইটভাটারও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে চালানো হচ্ছে। তারপরও অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে।’
জানতে চাইলে কেবিএম ইটভাটার মালিক রেজাউল করিম বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে অনুমতির জন্য আবেদন করেও পাওয়া যায়নি। এরপর উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভাটাগুলোর কার্যক্রম চলছে।’ পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. মাসুদ করিম বলেন, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দল কাজ করছে।

পাঠকের মতামত: