ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা পণ্যের ছড়াছড়ি

dakদেশের বিভিন্ন বাজারে জীবন রক্ষায় ব্যবহূত রোগ প্রতিরোধের অনিরাপদ চিকিৎসা পণ্যের ছড়াছড়ি। আর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা বর্তমানে নেই।

আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ হাসিল করছেন কিছু অসাধু আমদানিকারক কিংবা ব্যবসায়ী। তবে আগেও এসব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নিকট। গত ১ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘অনিরাপদ চিকিৎসা পণ্যের ঝুঁকিতে মানুষ’ শিরোনামের প্রেক্ষিতে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। যার পদক্ষেপ হিসেবে ১৩ নভেম্বর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কাছে ওষুধ, মেডিকেল ডিভাইস এবং ডায়াগনস্টিক রিয়েজেন্ট ছাড়করণের বিষয়ে একটি চিঠিও দেন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান। কিন্তু প্রশাসনের এ পদক্ষেপ মানতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। তারা আমদানি নীতির কথা বলে মেডিকেল সামগ্রীগুলোর কোনো ধরনের নিবন্ধন ছাড়াই ব্যবসা কার্যক্রম চালাতে চান। যে দাবি আদায়ে ৬ ডিসেম্বর থেকে টানা তিনদিন ধর্মঘট পালন করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল ইন্সট্রুম্যান্টস অ্যান্ড হসপিটাল এবং ইকুইপম্যান্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমআইএইচ এবং ইডিএমএ)। শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালককে লেখা চিঠিতে মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৪০ সালের ড্রাগ অ্যাক্ট অনুযায়ী যে কোনো ওষুধ বা মেডিকেল ডিভাইস আমদানিতে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন নেওয়া আবশ্যক। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য ভিন্ন এইচএস কোড ব্যবহার করে বিদেশ থেকে পণ্য আনছেন আমদানিকারকরা। ফলে দেশে মানবহির্ভূত ওষুধ ও মেডিকেল ডিভাইস ছড়িয়ে পড়ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি। জানা গেছে, বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে  গ্লাভস, সুই, সিরিঞ্জ, ইনজেকশন, সুতার ব্যবহার করা হচ্ছে কোনো ধরনের পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। ফলে চরম ঝুঁকিতে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করছে চিকিৎসা সেবা। বেশিরভাগ মেডিকেল ডিভাইস বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও তার মান সম্পর্কে অবগত করা হয় না কর্তৃপক্ষকে। এমনকি কর্তৃপক্ষও ছিল উদাসীন। এতে রোগীর জীবন দিন দিন হুমকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনিরাপদ চিকিৎসা পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ব্যবহারের ফলে ঘটতে পারে অসুস্থতা, ক্ষত, এমনকি মৃত্যু। আর এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনসহ আরও কিছু বিদ্যুিনর্ভর যন্ত্রপাতি আছে, যেগুলোর মান সম্পর্কে বোঝার কোনো উপায় থাকে না। কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই কোনো ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও নেই কোনো আইন। সুবিধাভোগী চিকিৎসকরাও অসৎ উদ্দেশ্যে ভালো মানের কথা বলে মানহীন সামগ্রী রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করে থাকেন। এসব যন্ত্রপাতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মান নিয়ন্ত্রণ ও যাচাইয়ের শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা সামগ্রীগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করা আরও বেশি জরুরি বলে তারা মনে করেন। তাদের মতে, একজন রোগী প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসার সময় নির্ভর থাকেন একজন চিকিৎসকের ওপর। যখন ইনজেকশনের সুই কিংবা সুতা ব্যবহার করা হয়, তখন কর্তৃপক্ষও জানে না সেগুলো ভালো, না খারাপ। এর পরও সেগুলো রোগ নির্ণয়, রোগ প্রতিরোধ, পর্যবেক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ সারাতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যেখানে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় চিকিৎসায় ব্যবহূত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেশে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানি করার ক্ষেত্রে। কিন্তু আমদানিকারক ও উৎপাদকরা দেশে ব্যবহূত প্রায় ১৮০০ চিকিৎসা-সামগ্রীর মধ্যে প্রায় ১০০টি পণ্যের নিবন্ধন করিয়েছেন। সম্প্রতি চার হাজার চিকিৎসা পণ্য কিংবা ডিভাইসের তালিকা করেছে এবং সেসব নিবন্ধনের জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে যেসব চিকিৎসা-সামগ্রী পাওয়া যায় সে সম্পর্কে কোনো রোগীর পক্ষে তার মান যাচাই করা সম্ভব নয়। কারণ মান নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রমাণপত্র রাখা হয় না। তবে এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন অপারেশনের রোগীরা। ২০১৫ সালের একটি স্বাস্থ্য বুলেটিনে পাওয়া গেছে, এক বছরে দুই হাজার ৫১৪ জন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট থেকে হার্ট অপারেশন করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩.৭২ লাখ নারী প্রসবের সময় সিজার করিয়েছেন। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘কিছু জিনিস আছে যেগুলোকে আমরা ওষুধ হিসেবে গণ্য করি। ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু গাইডলাইন করা হয়েছে, যেখানে অনুমোদিত কোম্পানিগুলো মেডিকেল ডিভাইসের স্যাম্পল আমাদের ল্যাবে মান নিয়ন্ত্রণের পর বাজারজাত করে থাকে। এসবের মান নিয়ন্ত্রণে দুটি ল্যাব আছে। একটি ঢাকার মহাখালীতে আর অন্যটি চট্টগ্রামে। বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে মানুষের জন্য ৭টি ও ভেটেরিনারি ওষুধের ক্ষেত্রে ১৪টি দেশের অনুমোদন দেওয়া আছে।   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফ বলেন, ‘প্রতিটি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহূত পণ্যে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। অপারেশনের পর রোগীদের তা থেকে ইনফেকশন হতে পারে। আর আমদানির ক্ষেত্রে আগে ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে কোনটা মেডিকেল ডিভাইস আর কোনটা না। এরপর সে বিষয়ে নিবন্ধন পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএমআইএইচ এবং ইডিএমএর ঢাকা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা আমদানি নীতি অনুসরণ করে ব্যবসা করি। ন্যয়সঙ্গতভাবে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করছি। দ্রুত ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মেডিকেল ডিভাইসেস রেজিস্ট্রেশনের প্রস্তাবিত গাইড লাইন স্থগিত করতে হবে। তবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর দেরিতে হলেও যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানাই। যদিও সেটি মন্দের ভালো। আমদানির ক্ষেত্রে যেন কোনো দুর্বৃত্তায়িত না হয় সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।

– See more at: http://www.bd-pratidin.com/last-page/2016/12/17/192881#sthash.Wbssuhjz.dpuf

পাঠকের মতামত: