ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

প্রকট হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা

178701_168ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার থেকে :

চলমান নৃশংসতায় দিশেহারা রোহিঙ্গারা প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে । মানবিক সহায়তায় তাদের ঠেকাতে হিমসিম খাচ্ছে দেশের সীমান্ত রক্ষিবাহিনী। তবুও ঈমানের বন্ধনে আবদ্ধ রোহিঙ্গা মুসলমানেরা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা যেন অব্যাহতই রেখেছে।

এই অবস্থায় কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়ন ও টেকনাফের ২ ব্যাটালিয়ন বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের আটক করলেও তাদের প্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। সোমবার টেকনাফে প্রবেশকালে রোহিঙ্গা বোঝাই আরো সাতটি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। এ দিন ভোরে ও দুপুরে সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট দিয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। এ নিয়ে ১ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে ২৭২টি নৌকায় করে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক বা প্রতিহত করা হয়েছে। ওই নৌকাগুলোর প্রতিটিতে ১৫-২০ জন রোহিঙ্গা ছিল। বিজিবি এসব রোহিঙ্গার প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করলেও তারা অন্য পয়েন্ট দিয়ে ফের পুশইন হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়ের চেষ্টা করছে। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, নাফ নদী পার হয়ে সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট দিয়ে সোমবার ভোর পর্যন্ত রোহিঙ্গা বহনকারী সাতটি নৌকা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। এ সময় বিজিবির টহল দলের সদস্যরা তাদের বাধা দেয় এবং মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়। সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন কর্নেল আবুজার আল জাহিদ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে বাঁচতে নাফ নদী পার হয়ে সীমান্ত দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের প্রত্যাশায় বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবৈধভাবে ঢুকেও পড়ে। বাংলাদেশে প্রবেশকারী রোহিঙ্গারা দাবি করছেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনীর বর্বরতা অব্যাহত রয়েছে। এতে রোহিঙ্গা সমস্যা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে ১২ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক মাসের মধ্যে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা দমন অভিযানে ভিটেমাটি হারিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগরা শুধু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপরই অত্যাচার করে না, বাংলা ভাষাভাষী সব ধর্মের মানুষই তাদের অত্যাচারের শিকার। ১৯৯১ সালে আসা উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রাজেশ কুমার, রবীন্দ্র শীল ও লাল মোহন শীল জানান, তারা ’৯১ সালে মিয়ানমারের মংডু থেকে সে দেশের সামরিক বাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের অত্যাচারে দেশ ত্যাগ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখনো ফিরে যেতে পারেননি। এরপর এখন নতুন করে আসছে নির্যাতিতরা। তবে বিজিবির নজরে এলে রোহিঙ্গাদের নাফ নদী থেকেই দেশে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা আরো জানান, রাখাইনে অনেক হিন্দুও বাস করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগরা (রাখাইন) শুধু আরাকানে বাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের অত্যাচার করে না, বাংলাভাষী সব ধর্মের মানুষকে অত্যাচার করে। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং সহায়সম্পদ লুট করে। হিন্দুদের মিলিটারি ও মগরা ‘ইন্ডিয়ান অভিবাসী’ নামে অভিহিত করে। আর বাংলাভাষী মুসলিমদের বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধভাবে আসা বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলায় কথা বললে বলা হয় বহিরাগত। কিন্তু মিয়ানমারে বসবাসকারী হিন্দিভাষীদের সে দেশের সংবিধানে ‘ইন্ডিয়ান’ নামে স্বীকৃতি দেয়া হলেও বাংলাভাষী হিন্দু বা মুসলমানকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। ১৯৮২ সালের একটি আইনে এদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে। এভাবে মিয়ানমার শাসকেরা যুগ যুগ ধরে এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ‘বাঙালিদের’ ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে বলে তারা জানান। তারা জানান, এ কারণে রোহিঙ্গারা দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকেই ভারত ও চীনেও আশ্রয় নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি ও সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ইকরামুল কবির চৌধুরী বাবলু বলেন, মিয়ানমারের কারণেই যেহেতু আমাদের সঙ্কট; তাই মিয়ানমারকে চাপে রেখেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা দরকার বাংলাদেশের। তিনি বলেন, যেসব বাঙালি হিন্দু বংশপরম্পরায় মিয়ানমারে বাস করছে, তারাও নির্যাতনের শিকার। আরাকানের খেয়ারিপ্যারাং এলাকা থেকে পালিয়ে আসা আবদুল ওয়ারেছের ছেলে আবদুর রহিমের (৩০) একটি চোখ নষ্ট। তার পিতাকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। বেয়নেটের খোঁচায় তার একটি চোখও চিরতরের জন্য নষ্ট করে দিয়েছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে পরিবারের ছয় সদস্যকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। তাদের সাথে পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে এসেছেন একই এলাকার দিল মোহাম্মদের ছেলে মোহাম্মদ ইউনুছ (২৬)। তিনি গুলিবিদ্ধ। এ ছাড়া আহত হয়ে আরো এসেছেন পরিবারের তিন সদস্য নিয়ে আবদুল হাই এবং চার সদস্য নিয়ে মোহাম্মদ ইলিয়াছ (২৬)। তাদের সাথেই প্রতিবন্ধী তিন শিশুকে নিয়ে কুতুপালং এসেছেন জাহেদা বেগম। তিনি জানান, তার স্বামীকে সেনাসদস্যরা হত্যা করে তিনিসহ তার সন্তানদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। এ কারণে আতঙ্কে তিনি দেশ ছেড়েছেন। কুতুপালং শিবিরের বাসিন্দা ফাতেমা জানান, মিয়ানমার থেকে ১৫ পরিবারের শতাধিক রোহিঙ্গা এসেছে প্রায় উদোম গায়ে। তিনি জানান, বর্তমানে মাত্র ১০০ বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট তার বাসাতেই ২০ জন মানুষ থাকে।

কুতুপালং শিবিরে আসা এসব রোহিঙ্গার খাবারের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারো সাহায্য পেলে খান, নয়তো উপোস থাকেন। জানালেন মিয়ানমার থেকে আসা আবদুর রহিম। তিনি জানান, নতুন আসা রোহিঙ্গারা এখন কাজের সন্ধানে ছুটছেন। কিন্তু অসুস্থরা নিজেদের ভরণপোষণ নিয়ে খুব উদ্বেগে রয়েছেন। অপর দিকে কফি আনানের নেতৃত্বাধীন জাতিসঙ্ঘ কমিশন সহিংসতাপূর্ণ উত্তর আরাকান পরিদর্শন শেষে রাজধানী নেপিতোতে পৌঁছে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিস্থিতির জন্য চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ সময় কফি আনান বলেন, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা রাখাইন বৌদ্ধদের সাথে মিলেমিশে বাস করতে চায়, কিন্তু রাখাইনরা তা চায় না। উল্লেখ্য, টেকনাফ ও উখিয়ায় রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী। এ ছাড়া নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কয়েক লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস করছে। ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ মিয়ানমারে ফিরে গেলে বাংলাদেশে এখনো রয়েছে ত্রিশ হাজারেরও অধিক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে থাকলেও এখানে বিভিন্নভাবে প্রবেশ করেছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে টেকনাফে লেদা, শামলাপুর ও উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় অনিবন্ধিত ক্যাম্প তৈরি করে বাস করছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এ ছাড়া কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙ্গামাটিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসিত করা হয়েছে ৯২৬ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে। এর মধ্যে কানাডায় ৩০৯ জন, যুক্তরাজ্যে ১৯০ জন, নিউজিল্যান্ডে ৫৬, যুক্তরাষ্ট্রে ২৪ জন, নরওয়েতে চারজন, আয়ারল্যান্ডে ৮২ জন, সুইডেনে ১৯ জন ও অস্ট্রেলিয়ায় ২৪২ জন। বাংলাদেশে রয়ে যায় বাকি শরণার্থীরা। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া ও উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকায় দু’টি ক্যাম্পে বর্তমানে নিবন্ধিত শরণার্থীর সংখ্যা হচ্ছে ৩১ হাজার ৭৫৯ জন। এর মধ্যে কুতুপালংয়ে ১৩ হাজার ৪৫ জন ও নয়াপাড়ায় ১৮ হাজার ৭১৪ জন। মিয়ানমার সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশনের মংডুর ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শন এদিকে মিয়ানমারের আরাকানের মংডুতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন মিয়ানমার সরকারের তদন্ত কমিশন। সোমবার সকালে মিয়ানমারের সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশন প্রধান ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউ মাইন্ড সুইর নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত টিম সরেজমিন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের সামগ্রিক অবস্থা পরিদর্শন করেছে। শত সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখেও রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা দেখাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউ মাইন্ড সুইর সাথে তার নেতৃত্বাধীন অন্যান্য সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তারা রাখাইন রাজ্যে (আরাকান) স্থানীয় মুসলমানদের গণহত্যার স্থান পরিদর্শন করেছে। সরকারি বাহিনীর অগ্নিসংযোগ করা ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শন করেছে। কথা বলেছে নির্যাতনের শিকার লোকজনের সাথে। এ দিকে রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন। আরাকান রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে সেখানকার সেনাবাহিনী, আর তারই অংশ হিসেবে মিয়ানমার সরকার গোপনে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে স্থানীয় রাখাইনদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। এবং তাদের গোপনে হত্যার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

 

পাঠকের মতামত: