ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

“রাখাইনের সবুজ গ্রাম এখন আগুনে পোড়া বিরাণভূমি’

ডেস্ক রিপোর্ট ::

বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িrakhain-lg20161205132832ত এক জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের( সাবেক আরাকান রাজ্য) মুসলিম রোহিঙ্গা। দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়ছেন তারা। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাদের। হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছেন একটু আশ্রয়ের আশায়। ঢুকে পড়ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশেও।

নির্যাতিত এই জাতিগোষ্ঠীর খবর জানাতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। তার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে নবম পর্ব।

মাত্র এক মাস আগেও লোকে লোকারণ্য ছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যটি। দিগন্ত জুড়ে ছিলো সবুজ আর সবুজ। বাতাসে ছিল নিদারুণ ঘ্রাণ, সবুজ মাঠে দুলতো সোনালী ধান। গাছ-গাছালি আর পাখির কলতানে রোজ ঘুম ভাঙতো রাখাইনের বাসিন্দাদের। কিন্তু সেই রাখাইন রাজ্য এখন যেন বিরাণভূমি। জ্বলে-পুড়ে ছাই। সেনাবাহিনী আর স্থানীয় মগ দস্যুদর তাণ্ডবে মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে রাজ্যটি। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
village
গত কয়েক দিন ধরে দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর সেনাবাহিনী ও মগ দস্যুদের নির্মম তাণ্ডব চলছে। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে রোহিঙ্গা মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছে। পুরুষ ও ছেলেদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ঘরবাড়ি। মিয়ানমারের এ রাজ্যটি যেন এখন পোড়ামাটির স্তূপ।

নির্যাতনের কবল থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৯ নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর তাণ্ডব চালাচ্ছে। টিকতে না পেরে দেশটির কয়েক হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করছেন। মিয়ানমারের সরকারি হিসেবে সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৮৬ জন নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হলেও বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা কয়েকগুণ। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দাবি এই সংখ্যা হবে দেড় সহস্রাধিক।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। কমপক্ষে সাড়ে ১২শ স্থাপনা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে মংডুর দক্ষিণাঞ্চলের নুরুল্লাহ গ্রামে অবস্থিত মুসলমানদের ঐতিহাসিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটিসহ শতশত মসজিদ, মাদরাসা ও ঘরবাড়ি। সর্বস্ব হারিয়ে  এসব রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আশ্রয়ের আশায় দিগ্বিদিক ঘুরছেন। পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গার ঘরবাড়ি দখল করে নিয়েছে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইনরা।

পালিয়ে আসারা জানান, সেনা বাহিনী কর্তৃক ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা হত্যা ও নারী ধর্ষণসহ অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। পুরুষ রোহিঙ্গাদের মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে কিশোরী মেয়েদের ধর্ষণ দেখতে বাধ্য করা হচ্ছে। ঘরের মধ্যে আটকে রেখে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী দেশটির স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে এক যোগে আকষ্মিক তাণ্ডব চালাচ্ছে। পুড়িয়ে দেয়া আগুনে রোহিঙ্গাদের কোলের শিশুদের জীবিত পেলে হত্যা করা হচ্ছে। নির্যাতনের ভয়াবহতা বর্ণনাতীত।

Rohinga

গত ৯ নভেম্বর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা ঢেকিবুনিয়া, কুমিরখালী, শিলখালী, বলিবাজার, পোয়াখালী, নোয়াখালী ও নাগপুরাসহ অন্তত ২০টি গ্রামে দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগ দস্যুরা একযোগে কমান্ডো স্টাইলে স্থল ও আকাশ পথ ব্যবহার করে তাণ্ডব চালায়। হাত-পা বেঁধে জবাই ও গুলি করে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় রাজ্যের কাঁচামাটি যেনো পোড়া মাটিতে পরিণত হয়েছে। খোদ স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও সে চিত্র দেখা যাচ্ছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। বর্তা সংস্থাটি নির্যাতনের প্রমাণ হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কিয়েত ইয়ো পিন এবং ওয়া পিক গ্রামের দুটি ছবি প্রকাশ করে।

রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর তাণ্ডব শুরুর আগে ও পরের দুটি স্যাটেলাইট ছবি দেখানো হয়। এতে দেখা যায়, অভিযানের আগের ছবিতে গ্রামে দুটোর চিত্র ছিলো সবুজ আর সবুজ। পরের ছবিটি পোড়ামাটির স্তূপ। এর মধ্য দিয়েই রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর কি পরিমাণ নির্যাতন করা হয়েছে সে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এ অবস্থায় শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল মংডু এলাকা পরিদর্শনে গেয়েছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিষয়ক কমিশনের প্রধান কফি আনান। তার আগমনের খবর শুনে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হতে থাকলে সেনাবাহিনী তাদের সরিয়ে দেয়। ফলে বর্বরতার শিকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি তিনি।

Rohinga

সেখানে অবস্থানকরা রোহিঙ্গাদের আশা ছিলো অন্তত নিজেদের দুঃখ দুর্দশা ও নির্যাতনের চিত্র তাকে বলতে পারবেন। সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে তা আর বলতে পারেননি নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। নিরুপায় হয় আবার সীমান্ত এলাকায় চলে আসেন অনেকেই। এখন অপেক্ষা করছেন বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে বাংলাদেশের পালিয়ে আসবেন।

এদের একজন ইয়াছিন। তিনি গত সোমবার সকালে মিয়ানমার সীমান্তের ওপর থেকে জাগো নিউজকে বলেন, তারা কফি আনানের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। ওই এলাকায় তারা জড়ো হলে রাখাইনরা বিক্ষোভ করতে থাকে। সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে তাদের (রোহিঙ্গাদের) সরিয়ে দেয়। তবে কেউ কেউ সহাস করে কথা বলেছেন। কিন্তু ভাষাগত কারণে কফি আনান তা বুঝতে পেরেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে রোহিঙ্গাদের।

এদিকে কফি আনান মংডুতে পৌঁছলে রাখাইনের কট্টরপন্থীরা বিক্ষোভ প্রদর্শণ করতে থাকে। এসময় সেনাবাহিনী তাদের কোনো বাধা দেয়নি। তবে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার চিত্র তিনি দেখতে পারবেন বলে জানান এই রোহিঙ্গা মুসলিম। সুত্র ” জাগো নিউজ

পাঠকের মতামত: