ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

কাজু বাদামে অপার সম্ভাবনা পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয়ের হাতছানি

অনলাইন ডেস্ক :::kajubadam

দেশের পার্বত্য অঞ্চলে স্বল্প পরিসরে বেসরকারিভাবে কাজু বাদামের চাষ হচ্ছে। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা ছাড়াই চলছে এ চাষাবাদ। এ খাতের উন্নয়নে চাষিরা সরকারের কাছ থেকে কোনো উৎসাহ, প্রণোদনা, সাহায্য ও সহযোগিতা পাননি। সম্ভাবনাময়ী খাতটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত রয়েছে।

কাজু বাদাম একটি পুষ্টিকর এবং মজাদার খাদ্য। এটি উৎকৃষ্ট শিশুখাদ্যও বটে, যার চাহিদা সারা দুনিয়াতে। কিন্তু বাংলাদেশে কাজু বাদামকে উচ্চবিত্তদের খাবার বলে গণ্য করা হয়। কাজু বাদাম থেকে অল্প খরচে হাজার হাজার টন পুষ্টিকর জুস উৎপাদন হবে। এ জুসে অনেক পুষ্টি উপাদান ছাড়াও কমলার চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি ভিটামিন ‘সি’ আছে। এ জুস দেশের মানুষের ভিটামিন ‘সি’র অভাব পূরণে সহায়ক হবে। আর কাজু বাদামের গাছগুলো হাজার হাজার টন গ্রিন হাউস গ্যাস (কার্বন ডাইঅক্সাইড) শোষণ করে।

স্বল্প পরিসরে দেশে কাজু বাদাম চাষ হলেও অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। সরকারি সহযোগিতা পেলে বেসরকারিভাবে উৎপাদন করে বিশ্বের কাজু বাদাম রফতানির শীর্ষ তালিকায় নাম লেখাতে পারে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে এ পেশায় প্রায় ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। উৎপাদিত কাজু বাদামের ৭৫ শতাংশ রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (৬০০ মিলিয়ন ডলার) রফতানি আয় করবে বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রতি ২০১৫-১৮ সাল পর্যন্ত প্রণয়ন করা রফতানি নীতিমালায় কাজু বাদামকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে চাষিদের উৎপাদন ও রফতানিতে উৎসাহ প্রদান, সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও তথ্য দিয়ে সহায়তা করার কথাও নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নীতিমালার আলোকে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।

কাজু বাদাম চাষিদের অভিমত‒বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলসহ (বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি) সিলেট, ময়মনসিংহ, শেরপুর, টাঙ্গাইল ও কুমিল্লা জেলায় এক লাখ হেক্টরের বেশি পতিত জমি রয়েছে। স্বল্প মূল্যে পাওয়া যাবে সেই জমি। সরকারি সহযোগিতা পেলে ওই জমিতেই ন্যূনতম এক লাখ মেট্রিকটন উন্নতমানের কাজু বাদাম ফলন করা সম্ভব। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশেই সহজলভ্য হয়ে উঠবে তা।

চাষিদের অভিযোগ‒কাজু চাষের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের নিয়ে একটি আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি। এ ছাড়া বীজ বপণ ও গাছ পরিচর্যার বিষয়েও কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা না থাকায় এই কৃষিপণ্যের সম্ভাবনা শতভাগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কাঁচা বাদাম বিক্রি করে তারা লাভের মুখ দেখলেও প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা থাকলে আরও প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হতো। বাগান-মালিকদের লাভও বেড়ে যেত কয়েক গুণ। কাজু বাদাম চাষের ক্ষেত্রে গত তিন বছরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা পেলে এ খাতের ব্যাপক উন্নতি হতো।

জানা গেছে, বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাশাপাশি থানচি, রোয়াংছড়ি ও সদর উপজেলায় কাজু বাদামের চাষ হচ্ছে। নেচারাল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনআরডিপি) দীর্ঘদিন নিজ খরচে পার্বত্য অঞ্চলে তিন জেলায় কাজু বাদাম চাষ এবং চাষের উন্নয়নে কাজ করছে। প্রতি হেক্টরে দেড় থেকে দুই মেট্রিকটন বাদামের ফলন হয়। বিক্ষিপ্তভাবে রুমায় ৩৫০ এবং থানচিতে ২২০ মেট্রিকটন কাজু বাদাম ফলন হয়। তবে চাহিদা বেশি থাকায় প্রায় ৮৫ শতাংশ কাজু বাদাম প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই (খোসাসহ) রফতানি হচ্ছে কেজি প্রতি ৬০-৬৫ টাকা দরে। বাকি অংশ দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাচ্ছে এবং অন্যান্য দেশে রফতানি হচ্ছে। আর আমদানি করা প্রক্রিয়াজাত কাজু বাদাম দেশে কেজি প্রতি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হয়।

ভিয়েতনাম কাজু অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে কাজু বাদাম রফতানির শীর্ষে অবস্থান করছে ভিয়েতনাম। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে ভারত। সম্প্রতি ভিয়েতনাম ভারতকে টপকে শীর্ষ অবস্থান দখল করে নিয়েছে। দেশটি আশা করছে, বছর শেষে প্রায় ৩ লাখ টন কাজু বাদাম বিক্রি করে ২.৭ বিনিয়ন ডলার (১৬ হাজার কোটি টাকা) রফতানি আয় করবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাজু বাদামের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক এবং ক্রেতা। এ ছাড়াও প্রায় সব উন্নত দেশই কাজু বাদাম আমদানি করে। আর ভিয়েতনাম হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাজু বাদাম উৎপাদনকারী এবং রফতানিকারক দেশ। দেশটি মাত্র ১১ বছর আগে কাজু বাদামের চাষ শুরু করে। এখন পৃথিবীর এক নম্বর রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। আর এ সফলতার পেছনে রয়েছে সরকারের সরাসরি সহযোগিতা।

জানা গেছে, বাংলাদেশে অর্গানিক (রাসায়নিকমুক্ত) খাতের উন্নয়নে প্রথমবারের মতো একটি কর্মশালা আয়োজন করেছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস বিজনেস প্রোমশন কাউন্সিল (এপিবিপিসি) ও বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস্‌ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিওপিএমএ) এ কর্মশালাটির আয়োজক। ২৫ নভেম্বর সকালে বান্দবানের থানচি উপজেলায় এ কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বিজনেস প্রোমোশন কাউন্সিলের (বিপিসি) কোঅর্ডিনেটর (যুগ্ম সচিব) ফকির ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘এটা নিয়ে আগে কিছু কাজ হয়েছে। এখন আমরা চিন্তা করছি যে এটার বেশ পুষ্টিগুণ রয়েছে। আর এটার সব কিছুই ব্যবহার করা যায়। বাজারে এটার বেশ চাহিদা রয়েছে, দামও ভালো। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে এর চাষ করে ভালো উৎপাদন করা যায়। এর আগে এ পণ্যটিকে নিয়ে চাষি বা রফতানিকারকদের নিয়ে কোনো সেমিনার করা হয়নি। তাই পণ্যটির উৎপাদন বৃদ্ধি ও রফতানির লক্ষ্যে এবার বড় পরিসরে উদ্যোগ নেওয়া হবে। খুব সামান্য পরিমাণ পণ্য রাফতানি হয়ে থাকে। তবে এটা একটা সম্ভাবনাময়ী পণ্য। তাই বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে এ পণ্যের উন্নয়নে কাজ করবে।’

এদিকে রুমা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলেই উন্নতমানের কাজু বাদাম চাষ করা সম্ভব। এখানকার মাটি ও আবহওয়া বাদাম ফলনের জন্য উপযুক্ত। যে কোনো অনুর্বর পতিত জমিতেও ভালোমানের বাদাম চাষ করা সম্ভব। দেশে ও বিশ্ব বাজারে এ পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এ খাতের উন্নয়নে সর্বাত্মক সহায়তা করারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিওপিএমএ) সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, ‘কাজু বাদাম চাষে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে বেসরকারিভাবে কাজু বাদাম উৎপাদন করে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে ৬০০ মিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করা সম্ভব হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে পার্বত্য অঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় এক লাখ হেক্টরের বেশি পতিত জমি রয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে ওই জমিতেই বছরে ন্যূন্তম এক লাখ মেট্রিকটন উন্নতমানের কাজু বাদাম ফলন করা সম্ভব। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশেই সহজলভ্য হয়ে উঠবে এটি।’

 

পাঠকের মতামত: