ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ট্রাম্পের পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন বাংলাদেশি!

bd
সাইফুর রহমান ::::

১৯৮৯ সালের গ্রীষ্মের কোনো এক ছুটিতে হিলারি ক্লিনটন তার একমাত্র কন্যা চেলসিকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন লন্ডনে। গ্রীষ্ম ঋতুতে বিলেতের আবহাওয়া সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ ও মনোরম। এমনি সময়গুলোতে বেশির ভাগ সময়ই যখন তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টির উটকো উৎপাত থাকলেও জুন-জুলাইয়ে সূর্যের পর্যাপ্ত আলোর ঝলমলানিতে চারদিক উজ্জ্বল ও উষ্ণায়িত।  সেই খুশিতেই বোধকরি মনের আনন্দে কন্যা চেলসিকে সঙ্গে নিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন হিলারি। হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো পিকাডেলি সড়কের ওপর পুরনো ধাঁচের নান্দনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত রিজ হোটেলটির সামনে। তপ্ত দুপুরের উষ্ণতা উপেক্ষা করে শত-সহস্র মানুষ ভিড় করেছে এই পাঁচতারকা হোটেলটির সামনে। ঈষৎ কৌতূহলী হয়ে হিলারি এক আগন্তুকের কাছে জানতে চাইলেন, আচ্ছা বলতে পারেন এই হোটেলটির সামনে এতগুলো মানুষ হঠাৎ এমন জটলা করেছে কেন? কোনো সেলিব্রেটি এসেছে, তাই না? আগন্তুকটি সকৌতুকে বলল, সেলিব্রেটি তো বটেই। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো উঠেছেন এই হোটেলে। আর এই যে মানুষগুলো দেখছেন এরা এসেছেন নারী এই প্রধানমন্ত্রীকে একনজর দেখতে আবার কেউ এসেছে তার অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতে। হিলারিও চেলসিকে সঙ্গে নিয়ে ভিড় ঠেলে সন্তর্পণে দাঁড়িয়ে গেলেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা মানুষের সারির একেবারে পশ্চাতে। চেলসি চেঁচিয়ে উঠল— মা তুমি কি করছ! এই ক্যাঁতক্যাঁতে ভিড়ের মধ্যে আমাদের দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন আছে কি। হিলারি আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, মামণি আমরা নিজেরা পৃথিবীর অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্য দেশ বলে দাবি করেও আজ পর্যন্ত যা করতে পারিনি অথচ একটি মুসলিম দেশ তা করে দেখিয়েছে। ওরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে একজন নারীকে। এই নারীটিকে নিজ চোখে দেখব না বা একটি অটোগ্রাফ নেব না— তা কি করে হয়। হিলারি ক্লিনটন তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘লিভিং হিস্ট্রি’তে লিখেছেন— “বেনজির ভুট্টোই ছিলেন একমাত্র খ্যাতনামা ব্যক্তি যাকে একবার দেখার জন্য আমি লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিলাম। তার মোটর বহর না আসা পর্যন্ত চেলসি আর আমি সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছু সময় ধরে। হঠাৎ আমরা দেখলাম হলুদ রঙের মিহি স্নিগ্ধ পোশাক পরিহিতা বেনজির তার লিমুজিন থেকে নেমে এলেন এবং প্রলম্বিত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন লবির দিকে। তাকে তখন বেশ উজ্জ্বল, শান্ত ও একাগ্র দেখাচ্ছিল।” হিলারি ক্লিনটন ধীর পদক্ষেপে এক টুকরো কাগজ সঙ্গে একটি কলম নিয়ে বেনজিরের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন— অটোগ্রাফ প্লিজ। বেনজির চোখ তুলে তাকিয়ে সাদা কাগজখানায় খস খস করে লিখে দিলেন— শুভেচ্ছা তোমাকে। জীবনে অনেক বড় হও। অটোগ্রাফের এই বিষয়টি বেনজিরের একটি সাক্ষাৎকারে ইংল্যান্ডের দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য মিরর’ ঘটা করে ছেপে ছিল ২০০২ কি ২০০৩ সালের দিকে।  আমি তখন ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়ছিলাম।

ইংরেজ মহাকবি মিল্টনের একটি উক্তি এরকম— Childhood shows the man as morning shows the day. অর্থাৎ একজন মানুষের ছেলেবেলা/মেয়েবেলাটি দেখলেই বোঝা যায় মানুষটি কতদূর যাবে। ঠিক তেমনই সকালটি দেখলেই ধারণা করা যায় দিনটি কেমন হবে। সেই সূত্র ধরেই বলতে হয় হিলারি ক্লিনটনও মাত্র ১২ বছর বয়সে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। সেই অপরিণিত বয়সেই হিলারি বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলাধুলামূলক কর্মকাণ্ড সেই সঙ্গে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং প্রভূত দাতব্য উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহ করে সেগুলো তিনি তুলে দিতেন বিভিন্ন সংগঠনের হাতে। ভাগ্যের এক অমোঘ পরিণতিতে হিলারি আজ হয়তো ডেমোক্রেটিক দলের হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগ পর্যন্তও তিনি ছিলেন তার বাবা হিউ রডহ্যামের মতো রিপাবলিকান দলের অন্ধসমর্থক। তিনি তার সাড়া জাগানো আত্মজীবনী লিভিং হিস্ট্রিতে লিখেছেন— “১৯৬৬ সালে রিপাবলিকান পার্টির নবীন সমর্থক হিসেবে আমি তখনকার সময়ের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড ব্রুকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিলাম। মূলত সারা রাত জেগে থাকার ফলে সেদিন আমার চুলের অবস্থা হয়েছিল যাচ্ছেতাই। অনুষ্ঠানে আমার যেসব ছবি তোলা হয়েছিল সেগুলোতে নিজের চুলের এরকম বিশ্রী অবস্থা দেখে আজও আঁতকে উঠি আমি।” রিপাবলিকান দলের প্রতি হিলারি যে কী পরিমাণ অনুরক্ত ছিলেন তার আর একটি উদাহরণ দিচ্ছি— ১৯৬০ সালের নির্বাচনের সময় হিলারি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন রিপাবলিকান দল থেকে রিচার্ড নিক্সন ও ডেমোক্রেটিক পার্টির জন এফ কেনেডি। স্বভাবতই হিলারির বাবা রিচার্ড নিক্সনের সমর্থক ছিলেন এবং তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন নিক্সন অবশ্যই আমেরিকার জন্য একজন উপযুক্ত ও ভালো রাষ্ট্রপতি হবেন। কিন্তু ভোটের পর দেখা গেল জন এফ কেনেডিই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। সেই সঙ্গে আরেকটি খবর বাতাসে উড়তে লাগল, শিকাগোর মেয়র রিচার্ড জে. ডালির চাতুর্যপূর্ণ ভোট গণনাই নাকি কেনেডিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতিয়ে দিয়েছে। হিলারির বাবা হিউ রডহ্যামও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, হয়তো এমন কিছু একটা হয়েও থাকতে পারে। এই সংবাদ শোনার পর হিলারি ও তার এক স্পেনিস বংশোদ্ভূত বান্ধবী যার নাম বেটসি দুজনেই রেগে একেবারে আগুন। তারা দুজনে মিলে খোঁজখবর করতে লাগলেন আদৌ ভোট চুরির এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা। এর কিছু দিন পরেই হিলারির বান্ধবী বেটসি জানতে পারল যে, রিপাবলিকানরা ভোট জালিয়াতি বের করার জন্য ভোটার লিস্ট মিলিয়ে দেখার কাজে কিছু স্বেচ্ছাসেবক খুঁজছে। হিলারি ও বেটসি দ্রুত গিয়ে নাম লেখালেন সেই দলে। এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হিলারি লিখেছেন— “বেটসি এবং আমি দুই ভাগ হয়ে গেলাম এবং সম্পূর্ণ অপরিচিতদের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। এক দম্পতি আমাকে দরিদ্র একটি এলাকায় নামিয়ে দিয়ে গেল এবং বলল— যেন প্রতিটি ঠিকানা ধরে বাসায় বাসায় খোঁজ নিয়ে তাদের নাম জিজ্ঞেস করে সেই তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। আমি একটি খালি জায়গা পেলাম যেখানে দেখানো হয়েছে প্রায় এক ডজন ভোটার রয়েছে যারা ভোট দিয়েছিল। আমি অনেক লোকের ঘুম ভাঙিয়েছি এবং তারা আমার প্রতি বিরক্তিতে চিৎকার করেছে। আবার আমি একটা বারে ঢুকে মদ্যপানরত ব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার তালিকার কেউ সেখানে আছে কিনা। তারা এতই অবাক হয়েছিল যে, অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অবস্থা দেখে বারটেন্ডার আমাকে পরে আসতে বলল। কাজটি শেষ করে যখন রাস্তার এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছি ফেরার অপেক্ষায় তখন খুশি লাগছিল এই জন্য যে বাবার ধারণার প্রমাণ মিলেছে— কেনেডির জন্য ডালি সত্যিই ভোট চুরি করেছে।”

হিলারি তার স্মৃতিকথায় ভোট চুরির যে বর্ণনাটি সবিস্তারে দিয়েছেন সেটি কিন্তু আসলে সত্যি সত্যিই ঘটেছিল। ধামাচাপা দিয়ে ইতিহাসকে কখনো চিরকালের জন্য মাটিচাপা দেওয়া যায় না। ইতিহাস হলো আগুন। হয়তো একদিন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির এই নির্বাচনটিও বিবেচিত হবে ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় নির্বাচন হিসেবে। সে যাক, এই ভোট কারচুপিতে মূলত ভূমিকা রেখেছিলেন শুধু একজন আর সেই মানুষটি ছিলেন জন এফ কেনেডির পিতা জোসেফ প্যাট্রিক কেনেডি। আমার প্রশ্ন, এমন একটি ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে কী হতো। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, বাংলাদেশে এ ঘটনাটি ঘটলে বিজয়ী দলের সবাই জোসেফ প্যাট্রিক কেনেডির কাঁধ চাপড়ে বাহবা দিতেন। আর টকশোগুলোতে বিজয়ী সেই দলের নেতা ও মগজ বিকিয়ে দেওয়া বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বুকের ছাতি দুই ইঞ্চি উঁচু করে বলতেন, “ভুটে কারচুপি হইছে তো কি হইছে। আরে ভাই থামেন থামেন ভুটাভুটি হইলো গিয়া কৌশলের খেলা। কৌশলে যে জিতবো সে-ই ক্ষমতায় থাকবো। এইখানে আমি লজ্জার তো কিছু দেখি না।” কিন্তু সভ্য দেশগুলোতে রাজনীতির সৌন্দর্যময় দিক হচ্ছে, ইতিহাস যেমন জন এফ কেনেডির পিতার ভোট কারচুপির কথা ঘৃণাক্ষরে লিখে রেখেছে ঠিক তেমনি সোনার হরফে লেখা আছে, এ ঘটনা শোনার পর কেনেডির প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল সেই ইতিহাসও। আর এ কারণেই জন এফ কেনেডি আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ ১০ জন রাষ্ট্রপতির একজন। পাঠকবৃন্দ জেনে অবাক হবেন যে, নির্বাচনে জিতে জন এফ কেনেডির যেখানে খুশি হওয়ার কথা হলো তার উল্টো। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষিত তরুণ রাজনীতিবিদ ভোট কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হতে চাননি। চেয়েছিলেন নিজের যোগ্যতায় জয়লাভ করতে। ঠিক সেই দিনই পিতা সম্পর্কে তার হৃদয়ে ঘৃণার বীজ রোপিত হয়েছিল। সেই ঘৃণার পূর্ণ বিকাশ আমরা দেখি ১৯৬৩ সালে জন এফ কেনেডি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার কিছুকাল পর যখন এফবিআই এই খবর প্রকাশ করে যে, জন এফ কেনেডির নির্বাচনে তার পিতা প্যাট্রিক কেনেডি সেই সময়ের বিখ্যাত গায়ক ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার মাধ্যমে শিকাগোতে ভোট কারচুপি করতে মাফিয়া গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়েছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব ষড়যন্ত্রের কিছুই জানতেন না জন এফ কেনেডি। তার পিতার এসব অপকর্ম সম্পর্কে যখন অবগত হলেন, তখন জন এফ কেনেডি অসম্ভব ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হলেন। জন এফ কেনেডি তার বাড়ির দরজা পিতার জন্য চিরতরে বন্ধ করে দিলেন। তিনি পিতার সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক এক প্রকার ছিন্নও করলেন বলা যায়। প্যাট্রিক কেনেডির শেষ পরিণতিও ভালো হয়নি। ঘৃণ্য এসব কৃতকর্মের জন্য তাকে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যেতে হয়েছিল।

সে যাক যে আলোচনা করছিলাম সেখানে ফিরে আসি। হিলারি অতীতে একজন কট্টর রিপাবলিকান হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীতে কেন তিনি ডেমোক্রেটিক দলে নাম লেখালেন এর উত্তরও তিনি নিজেই দিয়েছিলেন তার আত্মজীবনীতে। মূলত দুটি ঘটনা তাকে রিপাবলিকান দল সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ ও নিস্পৃহ করে তোলে। আমি নিজেও ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি দেশের বেশির ভাগ শিক্ষিত ও বিবেকবান মানুষ সব সময় নিপীড়িতদের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর নিপীড়ককে ঘৃণা করে। হিলারির ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। ১৮৫৪ সালে অর্থাৎ এখন থেকে ১৬২ বছর আগে রিপাবলিকান দলটি গঠনের শুরু থেকেই দলটি সর্বক্ষেত্রে গোড়া ও কট্টরপন্থি হয়ে উঠতে থাকে। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক দলটি উদার নীতি গ্রহণ করার কারণে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। এ দলের মাধ্যমে নানা মত-পথের অনুসারীরা একটি প্লাটফর্মে এসে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। ১৯৬৯ সালে রিপাবলিকান দল থেকে রিচার্ড নিক্সন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় আমেরিকা অযাচিতভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যেটা আমেরিকার বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী পছন্দ করেনি। হিলারিরও সেটা পছন্দ ছিল না। আরেকটি ঘটনা হিলারিকে ডেমোক্রেট দলে যোগ দিতে দারুণভাবে প্ররোচিত করেছিল। রিপাবলিকান দলটি ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি কাউন্সিলে যেভাবে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল সেটা নিজ চোখে দেখার সুযোগ ঘটেছিল হিলারির। আসুন হিলারির মুখ থেকেই শুনি কী ঘটেছিল সেদিন— “আমাদের দুজনের কেউই শিকাগোতে অনুষ্ঠেয় ডেমোক্রেটিক কনভেনশনে যাওয়ার পরিকল্পনা করিনি। কিন্তু পুরনো শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর ভাবলাম ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ হেলায় হারানো ঠিক হবে না। বেটসি ফোন করে প্রস্তাব দিল নিজেদের গরজেই আমাদের সেখানে যাওয়া উচিত। আমি একমত হলাম। জানতাম, আমরা কোথায় যাওয়ার মতলব এঁটেছি তা টের পেলে বাবা-মা আমাদের ডেমোক্রেটিক কনভেনশনে যেতে দেবে না। সে জন্য আমরা কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেদিন ছিল ডেমোক্রেটিক কনভেনশনের শেষ রাত। সে রাতে গ্র্যান্ট পার্কে যেন নরক ভেঙে পড়েছিল। পুলিশের সারি দেখার আগেই আমরা কাঁদানে গ্যাসের গন্ধ পেলাম। আমাদের পেছনে জনতার মধ্য থেকে কেউ একজন পুলিশকে লক্ষ্য করে একটা ঢিল ছুড়ে মারে। অল্পের জন্য সেটা আমার মাথায় লাগেনি। পুলিশ এরপর লাঠিচার্জ শুরু করলে আমরা সেখান থেকে পালিয়ে আসি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, দেশে বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। গ্র্যান্ট পার্কে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশি বর্বরতা দেখে বেটসি আর আমি খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। জাতীয় টেলিভিশনেও এ সংক্রান্ত ছবি দেখানো হয়েছিল।”

২০০৩ সালে হিলারি ক্লিনটনের আত্মজীবনীটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা আমার পড়ার সুযোগ ঘটেছিল। বলতে দ্বিধা নেই যে, বইটি পড়ে আমি অতিশয় চমত্কৃত হয়েছিলাম। হিলারির দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিল প্রগাঢ় ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। বিল ক্লিনটনকে প্রেমিক রূপে পছন্দ করার পেছনেও ছিল বিল ক্লিনটনের দেশপ্রেম। হিলারি লিখেছেন— “১৯৭০ সালের শরৎকালে বিল ক্লিনটনকে চোখে না পড়াটা ছিল খুব কঠিন। ইয়েল আইন স্কুলে সে এলো। তার আগমনের সময় তাকে দেখে মনেই হচ্ছিল না সে অক্সফোর্ডে দুই বছর কাটানো একজন স্কলার। বরং তাকে ভাইকিংদের মতো লাগছিল। সে ছিল লম্বা এবং সুদর্শন। গালে লালচে বাদামি দাড়ি আর মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আমি যখন তাকে আইন স্কুলের শিক্ষার্থীদের লাউঞ্জে প্রথম দেখি তখন অন্য ছাত্রছাত্রীরা তাকে ঘিরে রেখেছে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমি তাকে বলতে শুনলাম… এবং শুধু তাই নয়, আমরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তরমুজ উত্পন্ন করি।” ক্লিনটনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করার পেছনেও ছিল হিলারির অসামান্য ভূমিকা ও অবদান। সেটি বিল ক্লিনটনের লেখা ‘মাই লাইফ’ গ্রন্থটি পড়লেই জানা যায়। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়নের দৌড়ে হিলারি প্রথম থেকেই ভালো অবস্থানে। আমাকে অনেকেই ট্রাম্প সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমি তাদের ট্রাম্প সম্পর্কে সাধারণত দুটি বিষয় বলি। এক. ট্রাম্পের কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি মনে হয় ট্রাম্পের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বাংলাদেশি! কারণ নির্বাচনের আগেই তিনি যেসব বিষয় তুলেছেন সেগুলো আগে কেউ কোনো দিন তোলেনি। যেমন— ভুয়া ভোটার, নির্বাচনে কারচুপি এবং সর্বশেষ, নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করে তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দিতে বললেন তিনি। আমি শতভাগ নিশ্চিত, তার মস্তিষ্কে বড় ধরনের সমস্যা আছে। দ্বিতীয় দিকটি হলো, হিলারি নির্বাচিত হলে তিনি যেমন হবেন আমেরিকার সর্বপ্রথম নারী রাষ্ট্রপতি ঠিক তেমনি ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তিনি হবেন আমেরিকার সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি। কারণ অনেকেরই ধারণা ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাবে এবং পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। বেশ কিছু দিন আগে আমার এক আমেরিকা প্রবাসী পাঠক আমাকে বললেন, আমেরিকানরা কখনো একজন নারীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নেবেন না। এ কারণে তার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি স্মিত হেসে বললাম, আপনার মতামতের ওপর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনার ইতিহাসবোধের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কারণ ইতিহাস বলে, আমেরিকানরা তাদের নিজেদের ভালোমন্দ বিষয়গুলোতে ষোলআনা সরেস। এ জন্য অতীতে তারা সাদা-কালো-প্রতিবন্ধী যে কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে কার্পণ্য করেনি। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ বছর রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রুজভেল্টের দুটি পা-ই ছিল অকেজো। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কিছুকাল আগে পলিও দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দুটি পা-ই কর্মহীন হয়ে পড়ে তার। তিনি সাধারণত হুইল চেয়ারেই চলাফেরা করতেন সর্বত্র। পা দুটো অকেজো ছিল বলেই হয়তো মাথাটি কাজ করত দারুণভাবে।  আমেরিকার শ্রেষ্ঠ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়— হার্ভার্ড ও কলম্বিয়া থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়েছিলেন আইনের ওপর।  এ জন্য আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমেরিকানরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই হিলারিকে নির্বাচিত করবে এবার।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

 

পাঠকের মতামত: