ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

চকরিয়ায় ১০ টাকার চাল বিক্রিতে ব্যাপক অনিয়ম: তালিকায় ইউপি সদস্য, ছেলে ও বিত্তবানরা : প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহে দুদক কর্মকর্তা

ছোটন কান্তি নাথ, নিজস্ব প্রতিবেদক ::
চকরিয়ায় ১০ টাকার চাল বিক্রির তালিকায় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, তার ছেলে ও বিত্তবানসহ অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ব্যক্তিরা তালিকায় স্থান পেয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার ১৮ ইউনিয়নের মধ্যে বিশেষ করে ঢেমুশিয়া, বরইতলী, বমু বিলছড়িসহ কয়েকটি ইউনিয়নের উপকারভোগীর তালিকায় এ ধরণের ব্যক্তির নাম অহরহ স্থান পেয়েছে। এতে হতদরিদ্র ও অস্বচ্ছল পরিবারগুলোকে ১০ টাকায় চাল বিক্রির জন্য সরকারের নেওয়া মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে যেতে চলেছে। এক্ষেত্রে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত জনপ্রতিনিধিরাই এই অনিয়ম ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল দলীয় লোকদের উপকারভোগীর তালিকায় স্থান করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্ব স্ব ইউনিয়নের হতদরিদ্ররা।
এদিকে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া এই মহৎ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মিশনে যেসব জনপ্রতিনিধি ও সরকারী কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছে তাদের ব্যাপারে মাঠপর্যায় থেকে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহে নেমেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে দুদক টিম। গতকাল মঙ্গলবার ওই কর্মকর্তার নেতৃত্বে দুদক টিম সরজমিন চকরিয়ায় এসে ইউনিয়ন ভিত্তিক উপকারভোগীদের তালিকাসহ নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শফি উল্লাহ। তাঁর নেতৃত্বে দুদক টিম মঙ্গলবার দুপুরে সরাসরি চকরিয়ায় এসে উপজেলা খাদ্য বিভাগ থেকে উপজেলার ১৮ ইউনিয়নের তালিকার ছায়াকপি সংগ্রহসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে দেওয়ার অভিযোগও সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম ফিরে গেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদক টিমকে সহায়তাকারী বেসরকারী সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, সরকার ভর্তুকী দিয়ে মাত্র ১০ টাকায় চাল বিক্রি করছেন শুধুমাত্র একেবারে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য। কিন্তু সরকারের এই মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ের একশ্রেণির জনপ্রতিনিধি নিজের দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ব্যক্তি, বিত্তবান এমনকি কোন কোন ইউনিয়ন পরিষদের খোদ সদস্য (মেম্বার) এবং তাদের পরিবার সদস্যরাও উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। যা সরকারের নীতির সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এসব অভিযোগ জানার পর দুদক টিম প্রাথমিকভাবে ১৮ ইউনিয়নের উপকারভোগীদের তালিকা সংগ্রহসহ নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।
তিনি আরো জানান, আপাতত প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে দুর্নীতি দমন কমিশনের ঢাকার ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এসব বিষয় তুলে ধরবেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে মাঠপর্যায়ে ১০ টাকার চাল নিয়ে চালবাজি বা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে নামবেন। প্রয়োজনে যেসব জনপ্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করবেন দুদক কর্মকর্তা।
সূত্র জানায়, সারাদেশের ন্যায় চকরিয়ার ১৮ ইউনিয়নের হতদরিদ্র, অসচ্ছল পরিবারের মাঝে ১০ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই লক্ষ্যে সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী প্রকৃত হতদরিদ্র পরিবারের তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও একজন পদস্থ সরকারী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত ইউনিয়ন কমিটিকে।
অভিযোগ উঠেছে, যেসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। একেবারে হতদরিদ্র, দুঃস্থ পরিবারের বিপরীতে দলীয় বিবেচনায় তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) ও তাদের পরিবার সদস্য, অপেক্ষাকৃত বিত্তবান পরিবারের সদস্যরাও তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এতে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকায় প্রকৃত উপকারভোগীরা তালিকায় স্থান পায়নি। ইতিমধ্যে এসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি কর্তৃক অনিয়ম-দুর্নীতির তালিকা (কার্ড নম্বরসহ) দুর্নীতি দমন কমিশন, জেলা প্রশাসক, চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
উপজেলার ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা নুরুল আলম জিকু, বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা জালাল আহমদ সিকদার, বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আবদুল মতলবসহ কয়েকটি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ অহরহ। তবে প্রকাশ্যে এসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মুখ খোলারও সাহস নেই প্রকৃত উপকারভোগীদের। এতে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যও ভেস্তে যেতে চলেছে এসব ইউনিয়নে।
আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ১০ টাকার চাল বিক্রিতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়া ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের চিত্র তুলে ধরা হলো। ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে তালিকাভুক্ত হওয়া ইউপি সদস্য (মেম্বার)ও তাদের নিকটাত্মীয় (পুত্র), স্বচ্ছল ও বিত্তবান ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুল মোনাফের পুত্র রমিজ উদ্দিন (কার্ড নম্বর ২৩৭), খোদ ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার আবু ছালেক (কার্ড নম্বর ৩৮৫), ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিত্তবান ব্যক্তি মোহাম্মদ ফারুক (কার্ড নম্বর ২২২), কামাল উদ্দিন (কার্ড নম্বর ২৭৭), ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বদি আলম (কার্ড নম্বর ২০৭), ছাদেক মিয়া (কার্ড নম্বর ২১০), ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আমেনা খাতুন (কার্ড নম্বর ১২৮), মফিজুর রহমান (কার্ড নম্বর ১০৭), মনির খান (কার্ড নম্বর ১১১), আবদুল কুদ্দুছ (কার্ড নম্বর ৯৩), ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সবে মেরাজ (কার্ড নম্বর ৩০৭), আবদুল জলিল (কার্ড নম্বর ২৯৬), কামরুন্নেছা (কার্ড নম্বর ৩০৬), রফিকুল ইসলাম (কার্ড নম্বর ৩২০), ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল জলিল (কার্ড নম্বর ৪০৩), ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ হোসেন (কার্ড নম্বর ৮৮)। শুধু তাই নয় ২ নম্বর ওয়ার্ডের এক পরিবারেরই ৫জন সদস্য তালিকায় স্থান পেয়েছেন। তাদের কার্ড নম্বর হলো ৬১, ৬৩, ৮৪, ৮৭ ও ৯০।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলার ঢেমুশিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল আলম জিকু দাবি করেন, ১০ টাকার চাল বিক্রির জন্য সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই নিয়মের মধ্যেই কার্ড বিতরণের পর চাল ক্রয় করছেন তারা। তিনি বলেন, অর্থের বিনিময়ে কোন বিত্তবান বা স্বচ্ছল ব্যক্তি উপকারভোগীর তালিকায় স্থান পায়নি। তাছাড়া দলীয় বিবেচনায়ও কাউকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং কার্ড অনুমোদন কমিটির সভাপতি মো. সাহেদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেসব ইউনিয়নে উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আসছে সেই অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে (কর্মকর্তা) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তালিকায় কোন স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম থাকলে কার্ড বাতিলসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পাঠকের মতামত: