বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোয় হঠাৎ করেই ঘুষের রেট আকাশচুম্বী করা হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স করার ক্ষেত্রেও এখন ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ গুনতে হচ্ছে। এসব নিয়ে বিআরটিএর দালাল ও কর্মচারীদের সঙ্গে গ্রাহকদের বাদানুবাদ-হাতাহাতি, হৈচৈ, বিশৃঙ্খলা এখন নিত্যনৈমত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভুক্তভোগী লাইসেন্সপ্রার্থীরা জানান, সৌদি আরবের যে কোনো কাজের ভিসায় যাওয়া ব্যক্তিদের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক করার পর থেকে বিআরটিএর ঘুষ রেট অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক মাস ধরে সৌদি আরবে কর্মসংস্থান চাহিদার বিপরীতে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়ছেন। কিন্তু সৌদি সরকারের নতুন আরোপিত নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো কাজ নিয়ে সে দেশে গেলেও তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী হতে হবে। ফলে বিভিন্ন টেকনিক্যাল কাজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাহিদা অনুযায়ী ‘ভুয়া’ হলেও ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড় করে তবেই সৌদি আরবের পথে পাড়ি দিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিআরটিএর ভুয়া লাইসেন্সের জন্য সবাইকে শুরুতেই দালালদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। সেখানে নগদ ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে তার পরই লাইসেন্স পাওয়ার কথা ভাবতে পারছেন তারা।
মাত্র এক মাস আগেও এসব লাইসেন্সের জন্য বিআরটিএ সরকারি ৩২০০ টাকার বিপরীতে ১০ হাজার টাকা ঘুষ আদায় করত। এখন একই লাইসেন্সের জন্য গুনতে হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা। আবার এ লাইসেন্স জরুরি পেতে হলে আদায় করা হচ্ছে ৩৫ হাজার টাকা। তবে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, নবায়ন, মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানের কার্যক্রমে ঘুষের রেট সামান্য কিছু বাড়ানো হলেও তা জুলুম পর্যায়ে পৌঁছেনি বলে ভুক্তভোগীরা দাবি জানান।
বিআরটিএ অফিসগুলো এখন দালালদের পাশাপাশি আনসার সদস্যদের কাছেও জিম্মি হয়ে পড়েছে। চিহ্নিত দালালদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিযুক্ত আনসার সদস্যরাও এখন দালালি কর্মকাণ্ডে বেশি তত্পর হয়ে উঠেছেন। আনসার সদস্যদের পক্ষ থেকে প্লাটুন কমান্ডার অথবা তার নিযুক্ত কোনো সদস্য দিনভর দালালি তত্পরতায় ব্যস্ত থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে দালালদের প্রবেশাধিকার রহিত করে সমুদয় কর্মকাণ্ড আনসার সদস্যরাই পরিচালনা করেন। এদিকে উত্তরায় বিআরটিএ কার্যালয়টি এখন খালেকের নেতৃত্বাধীন দালাল চক্রের কাছে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে আছে। দালাল খালেকের পাশাপাশি জাহাঙ্গীর, শিপন, টিপু, আমিনুলসহ কয়েকজন পৃথক পৃথক দালাল গ্রুপ গড়ে তুলেছেন। সেখানে বিআরটিএর নিযুক্ত কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয় বানিয়ে দালাল খালেক পাশের রেস্টুরেন্টকে আনুষ্ঠানিক কার্যালয় বানিয়েছেন। সেখানেই শত শত লাইসেন্সপ্রার্থী লাইন ধরে ঘুষের টাকা ও কাগজপত্র জমা দেন। দালাল চক্রের সদস্যরা সমুদয় কাগজপত্রের ফাইল বানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের থেকে কেবল স্বাক্ষর করিয়ে আনেন। সন্ধ্যার পর কর্মকর্তারা নিজেদের স্বাক্ষর গুনে গুনে তার প্রাপ্য ঘুষের টাকা দালাল খালেকের কাছ থেকে বুঝে নেন বলেও অভিযোগ আছে। দালালদের আদেশ-নির্দেশ শুনেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিশিয়াল কাজকর্ম চালাতে হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে খোদ বিআরটিএ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মিরপুর বিআরটিএ অফিসে দালাল চক্রের শিরোমণি হয়ে উঠেছেন আনসার পিসি ফরিদ। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই আনসার পিসিকে ঘিরে শত শত মানুষের ভিড় জমে থাকে। তিনি নিজের হাতে ঘুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরই অন্য আনসার সদস্যের মাধ্যমে কাগজপত্র বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট শাখা কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে লাইসেন্সপ্রার্থীরা ওই আনসার পিসি ফরিদের সঙ্গেই মোবাইলে যোগাযোগ রাখেন এবং তার দেওয়া সময় মোতাবেক হাজির হয়ে নিজের লাইসেন্সটি বুঝে নিতে সমর্থ হন। ইকুরিয়া বিআরটিএ কার্যালয়েও অভিন্ন অবস্থা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উত্তরা জোনের বিআরটিএ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (রেজিস্ট্রেশন) সুব্রত কুমার দেবনাথ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিআরটিএর কার্যক্রমে দালাল চক্রের উৎপাত ও টাকা লেনদেনের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। তবে সর্বোচ্চ সততা নিয়েই আমরা কাজ করে চলেছি। সব ধরনের ঝামেলা কাভার দিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়।’ সাংবাদিকদের সঙ্গেও তিনি সমঝোতা রেখে চলেন বলেও দাবি করেন। তবে যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে প্রতিদিন কর্মকর্তারা কী পরিমাণ ঘুষ নেন— এমন প্রশ্নে তিনি কোনো জবাব দিতে রাজি হননি। কেবল তার সহযোগী এক দালাল এই প্রতিবেদকের মোবাইল নম্বরটি সংগ্রহের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আপনার সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে আমরা যোগাযোগ রাখব, সন্তুষ্ট করব।
পাঠকের মতামত: