ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলার সহজ সরল পদ্ধতি!

গোলাম মাওলা রনি :
আমার আজকের নিবন্ধটি মূলত তাদের জন্য, যারা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে একদম দু’চোখে দেখতে পারেন না। জিয়ার নাম শুনলে যাদের গা-জ্বালা করে অথবা যাদের শরীর-মনে প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও ঈর্ষার দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে, তারাও আমার নিবন্ধ থেকে কিছুটা শান্তির পরশ পেলেও পেতে পারেন। যারা চান বাংলাদেশের মাটিতে ‘জিয়াউর রহমান’ নামে যে কেউ ছিল- সেই ইতিহাস মুছে ফেলতে অথবা জিয়াকে মানুষের মন-মননশীলতা ও চিন্তা থেকে চিরতরে বিদায় করে দেয়ার জন্য যারা নিরন্তর উল্টাপাল্টা চেষ্টা-তদবির চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তারা ইচ্ছে করলে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছলেও পৌঁছতে পারেন।
জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য আপনি মহামতি আলেক্সান্ডারকে অনুসরণ করতে পারেন, যিনি তার জাদুকরী প্রতিভা দ্বারা হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এবং তৎকালীন দুনিয়ার একমাত্র সুপার পাওয়ার, পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছিলেন। আপনি ভারতীয় পণ্ডিত চাণক্যের নীতিও অনুসরণ করতে পারেন, যিনি তার নিয়োগকর্তা মহামতি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে অমরত্বদানের জন্য পূর্ববর্তী নন্দ বংশের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অতিক্রম করে নতুন ইতিহাস রচনা করতে পেরেছিলেন। ইতিহাসের মহামতি সম্রাট আকবরকেও অনুসরণ করা যেতে পারে, যিনি ভারতের সবচেয়ে নাক উঁচু আর অহঙ্কারী রাজপুত জাতির ইতিহাসের ওপর মোগল আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছিলেন অবলীলায়। বাংলাদেশের যেসব লোক জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য কাজ করছেন, তারা মূলত উল্টোরথে চলে নিজেদের সর্বনাশ ঘটাচ্ছেন এবং জিয়ার ক্ষতি করার পরিবর্তে উপকার করে দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে ইতিহাসের একটি কাহিনী বলে মূল প্রসঙ্গে এগোতে চাইÑ পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগান্তকারী যুদ্ধটির নাম গাওগেমেলা। পারস্য সম্রাটের চৌকস এবং তৎকালীন দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ, দক্ষ ও পেশাদার তিন লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনীর মোকাবেলায় মাত্র চল্লিশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী দিয়ে মহামতি আলেক্সান্ডার যেভাবে নিজের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন, ঠিক সেভাবে আপনিও পারেন জিয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও দক্ষতার মাধ্যমে তাকে পরাজিত করতে। গাওগেমেলা যুদ্ধক্ষেত্রে আলেক্সান্ডার পারস্য বাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সফলতার কারণ এবং তাদের শক্তিমত্তার কৌশলগুলো জেনে নিয়েছিলেন। পারস্য বাহিনীর আধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি, শৃঙ্খলা ও যুদ্ধকৌশলের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর সেগুলো মোকাবেলা করার উপায় উদ্ভাবন করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অন্য দিকে, পারস্য রাজা তৃতীয় দারায়ুস আলেক্সান্ডারের দুর্বলতাগুলোর খোঁজ করেছিলেন এবং তার অল্প বয়স, সংখ্যালঘু সৈন্যবাহিনী এবং ইতঃপূর্বে বড় কোনো যুদ্ধজয়ের অভিজ্ঞতা না থাকাকে নিজের বিজয়ের জন্য সহায়ক মনে করে একধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল- তামাম দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে আলেক্সান্ডারই বিজয়ী হয়েছিলেন।
জিয়ার স্মৃতি মুছে দেয়ার জন্য চেষ্টা করার আগে আপনাকে অবশ্যই গবেষণা করে বের করতে হবে, কেন জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের হৃদয়ের রাজা হিসেবে যুগ-যুগান্তরে শুধু নিজের ‘দখলদারিত্ব’ বাড়িয়ে চলেছেন। কেন মানুষ জিয়ার নাম পাথর, পাহাড়, কিংবা প্রাসাদের গায়ে খোদাই না করে নিজেদের হৃদয়ে লিখে যাচ্ছে অনবরত। বাংলা ভূখণ্ডের প্রবাদতুল্য এবং কিংবদন্তির রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব যথা- আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা ফজলুল হক কিংবা কমরেড মণি সিং কেন বিএনপির মতো একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারলেন না অথবা আবুল হাশিমের খেলাফতে রব্বানী পার্টি, ভাসানীর ন্যাপ, ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক প্রজা পার্টি এবং মণি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টি কেন জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপির মতো স্থায়িত্ব ও ব্যাপকতা পেল না! কেন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা বারবার বিএনপিতে যোগদান করছেন? অন্য দিকে, বিএনপির কোনো শীর্ষ নেতা কেন এরশাদ-জমানা ছাড়া অন্য সময়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলেন না। এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়া বিএনপি নেতারা কেন অচিরেই তাদের মূল দলে ফিরে এলেন?
জিয়াবিরোধীদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ শুরু হলো, কিভাবে যুদ্ধ চলল, কারা যুদ্ধ করলেন এবং কেন করলেন ইত্যাদি প্রশ্নের নির্মোহ উত্তর না জানা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বা বিপক্ষে কথা বলা আর নিজেকে তামাশার বস্তু অথবা সার্কাসের সঙ বানানোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জিয়া শুধু গণমানুষের হৃদয় নয়- দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হৃদয়ের মণিকোঠাতেও ভালোবাসার মিসাইল স্থাপন করে গেছেন। সেই মিসাইল আজ অবধি কেন অন্য কেউ অপসারণ করতে পারলেন না, অথবা নতুন ভালোবাসার মিসাইল অথবা মন্ত্র দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের হৃদয়জট দখল করা হলো না?
জিয়া মুক্তিযোদ্ধা, নাকি পাকিস্তানের তৎকালীন সরকারের খয়ের খাঁ ছিলেন, তা বোঝার জন্য জিয়াবিরোধীদের আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সেনাবাহিনী, রাষ্ট্র ও রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রভাব এবং সামগ্রিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে হবে। ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও সুবৃহৎ সেনাবাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। সেই বাহিনীর একজন মেজরের পক্ষে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতির সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা সম্ভব কি না। অথবা পৃথিবীর কোনো সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে সেই দেশের সরকার প্রকাশ্য বিদ্রোহ করার জন্য অনুমতি দিয়ে, সরকারবিরোধীদের সাথে মিশে গিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার অনুমতি দেয়ার নজির আদৌ আছে কি?
বৃহৎ একটি সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র কর্মকর্তা যদি শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে হঠাৎ বলে ওঠেন- ও ৎবাড়ষঃ. তাহলে তার কী পরিণতি হতে পারে? পৃথিবীর ইতিহাসে এ যাবৎ কতজন মেজর একটি সরকার, একটি সেনাবাহিনী এবং একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলতে পেরেছেন- ‘আমি বিদ্রোহ করলাম!’ নিশ্চিত মৃত্যু- তাও আবার কোর্ট মার্শাল অথবা ক্রসফায়ার, এটা জানার পর একজন পাগল, নির্বোধ অথবা শিশু ছাড়া অন্য কোনো প্রকৃতি বা জাতের মানুষ এমনতরো দুঃসাহস দেখাতে পারে? সে কি ভীরু কাপুরুষ- নাকি মহাবীর! সে কি বেঈমান- বিশ্বাসঘাতক নাকি মহৎপ্রাণ দেশপ্রেমিক! যুদ্ধের ময়দান আর রঙ্গমঞ্চ কি এক? নাকি শতরঞ্চির রাজা-উজির, সৈন্য-ঘোড়া এবং যুদ্ধক্ষেত্রের গুলি-বোমা-গ্রেনেড ইত্যাদির মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য রয়েছে?
ব্যক্তি জিয়ার সততা, প্রশাসনিক দক্ষতা, স্বজনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার দুর্দমনীয় ক্ষমতা, আপন পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং তাদেরকে রাষ্ট্রীয় কর্মের ধারেকাছে ভিড়তে না দেয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত রাখার যে দুরন্ত সাহস, অনমনীয় মনোভাব আর চারিত্রিক দৃঢ়তা জিয়া দেখাতেন, তা কি জনগণ পছন্দ করত, নাকি এসব কারণে জিয়াকে লোকজন ছি ছি করে ঘৃণা জানাত; তাও খুব ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। জিয়ার প্রশাসনিক সংস্কার, আইন প্রণয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, চোরাচালান রোধ, জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড, খালকাটা, কৃষি বিপ্লব, বিদেশনীতি, অভ্যন্তরীণ নীতি, অর্থব্যবস্থার সফলতা এবং সর্বস্তরে স্থিতিশীলতা আনয়নের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি তৎকালীন জনগণ এবং সাম্প্রতিক কালের জনমানুষ কী রূপে বিবেচনা করে, তা মূল্যায়ন করা ব্যতিরেকে জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার অংশগ্রহণ, একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া এবং তার অধীনস্থ সেক্টরটির কর্মকাণ্ড কি বীরত্বপূর্ণ ছিল, নাকি তিনিসহ তার পুরো বাহিনী, কমান্ড ও সেক্টর পাকিস্তানিদের দোসর ছিল? মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার বীরত্ব অথবা তার ভাঁওতাবাজি, ছলচাতুরী, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সম্পর্কে দলিলপত্র না থাকলে তাকে কোনোভাবেই মোকাবেলা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়ার কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা অথবা অন্য কারো পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করাটি মূল্যায়ন করার আগে আরো কতগুলো প্রশ্নের জবাব খোঁজা আবশ্যক। কেন অন্য কোনো সেক্টর কমান্ডার, সেনাপতি বা উপসেনাপতি জিয়ার আগে বা পরে জিয়ার মতো করে কোনো ঘোষণা দিলেন না? কেন কোনো বেসামরিক ব্যক্তির ঘোষণা দেশবাসীর কর্ণকুহরে ঢুকল না? কেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জিয়ার আগে বা পরে অথবা মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না? এমনকি প্রবাসী সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও কেন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিলেন না ‘মুজিবনগর ঘটনা’র আগে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা তার ‘নেতা ও পিতা’ বইয়ে অভিযোগ করেছেন, তার পিতা সর্বোচ্চ মাত্রায় চেষ্টা-তদবির করেও টেপরেকর্ডারে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার ব্যাপারে কোনো ঘোষণা সংগ্রহ করতে পারেননি। ওই অবস্থায় শূন্য টেপরেকর্ডার নিয়ে তিনি ভারতে পাড়ি দিতে বাধ্য হন। তাজউদ্দীনকন্যার বই পাঠ করার পর অনেক পাঠক মন্তব্য করেছেন- তিনি তো জিয়ার মতো বাংলাদেশ ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একটি ঘোষণা দিতে পারতেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সুদীর্ঘ ৯ মাসের মধ্যে যুদ্ধরত সেনাবাহিনী, মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় মিত্রবাহিনী, পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের দোসরদের ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে না পারলে কারো পক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ভাবধারা হৃদয়ে ধারণ করা সম্ভব নয়। আর মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে কোনো কথা গ্রহণীয় হতে পারে না।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়ার সময়কালকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই তার ক্ষমতার সাড়ে তিন বছর এবং ক্ষমতাগ্রহণের আগের সাড়ে তিন বছর ইতিহাসের নিরপেক্ষতার কষ্টিপাথর দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। দু’টি সময় সম্পর্কে তৎকালীন জনগণ এবং বর্তমান জনগণের ধারণা সম্পর্কে আপনাকে ওয়াকিবহাল হতে হবে। কোন সময়কালে জনগণ খুশি ছিল অথবা কোন সময়ে জনগণের মন ক্লান্তি, ক্লেদ, ক্ষোভ ও হতাশায় পূর্ণ ছিল? জিয়ার জীবদ্দশায় কতজন মানুষ গোপনে তার মৃত্যু কামনা করতেন এবং তার মৃত্যুর পর কতজন মানুষ উল্লাস প্রকাশ করেছেন; এর সমীকরণ জিয়াবিরোধীদের অবশ্যই করতে হবে। জিয়ার মৃত্যুর পর মানুষের হৃদয়ে শোক ও আনন্দের বন্যার তুলনামূলক বিচার ছাড়া জিয়ার স্মৃতি বিলোপ প্রকল্পে হাত দেয়া ঠিক হবে না।
রাজনীতিবিদ জিয়ার সফলতা ও ব্যর্থতা এবং বিএনপির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে দেখার আগে পাক-ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস আপনাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় ৬২ বছর পর ভারতীয় কংগ্রেস স্থিতিশীলতা ও ক্ষমতা পেয়েছিল ভারত স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে এবং প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর পর ক্ষমতা ও স্থিতিশীলতা পেয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। পরে তা পরিবর্তিত হয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নাম ধারণ করে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের অংশীদার হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় সরকার গঠনের অংশীদার হলেও দলের মধ্যে স্থিতিশীলতা ছিল না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালেও দলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সত্যিকার স্থিতিশীল দল হিসেবে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্ম শুরু করতে পেরেছিল ১৯৯১ সালে এরশাদশাহীর পতনের পর। সে ক্ষেত্রে জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপির প্রাথমিক স্থিতিশীলতার গোপন রহস্যটি অবশ্যই জিয়াবিরোধীদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।
প্রয়াত জিয়াউর রহমান সম্পর্কে উল্লিখিত বিষয়াদির পাশাপাশি তার হাঁটাচলা, কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি, প্রতিশ্রুতি পালন, ধর্মকর্ম, সদাচার, জনকল্যাণ, দান-খয়রাত, পোশাক-আশাক, রুচিবোধ, সময়ানুবর্তিতা, আহার-নিদ্রা, বিশ্রামের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তার শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক সচ্ছলতা ও আভিজাত্য, তার পিতামাতা, আত্মীয়স্বজনের সুনাম না জেনে তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অসম্ভব। কারণ প্রকৃতির সহজ নিয়ম হলো- প্রতিটি কর্মের সমান প্রতিক্রিয়া রয়েছে। প্রকৃতির এই সূত্র মতে, মন্দ কর্ম প্রতিহত করতে হয় মন্দ কর্ম দ্বারা। অন্য দিকে, ভালো কর্মকে অতিক্রম করতে হলে কেবল অধিকতর ভালো ও মহৎ কর্মের সফল বাস্তবায়ন দরকার।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের যাবতীয় কর্ম, জীবনাচরণ এবং স্মৃতিগুলো মূল্যায়ন করার পর আপনাকে অবশ্যই ওসব কর্মের হালনাগাদ লভ্যাংশ এবং কিছু বোনাস যোগ করে নিজের শুভকর্মগুলোর তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। এরপর আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন কোন কাজের স্মৃতি আপনি মুছতে চান? আপনি যদি সৈনিক অথবা সেনাপতি জিয়াকে মোকাবেলা করতে চান, তবে অবশ্যই আপনাকে সৈনিক কিংবা সেনাপতি হতে হবে- তাও আবার তার সমপর্যায়ের পদ-পদবিধারী না হলে চলবে না। আপনি যদি মুক্তিযোদ্ধার কীর্তিগাথা ও বীরত্বকে অতিক্রম করতে চান, তবে আরো একটি মুক্তিযুদ্ধ এবং আরো একটি রণাঙ্গন ছাড়া আপনার আশা পূর্ণ হওয়া অসম্ভব। আপনি যদি জিয়ার চেয়েও অধিকতর সাহস, দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্ব ভরা কণ্ঠ নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চান, তবে মহান আল্লাহকে বলতে হবে আপনার চলমান বর্তমানকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের উত্তাল দিনগুলোতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য।
রাষ্ট্রপতি জিয়া, রাষ্ট্রনায়ক জিয়া অথবা সরকারপ্রধান জিয়ার স্মৃতি মোচনকারীকে অবশ্যই সম্পদের অধিকারী হতে হবে। রাজনীতিবিদ জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য বিএনপির চেয়েও বড় একটি দল জিয়ার চেয়েও কম সময়ে গড়ে তোলার কৃতিত্ব আপনার থাকতে হবে। জিয়ার ভিশন, মিশন ও উৎপাদনশীলতা অতিক্রম করার জন্য মরুর বুকে সবুজ বনায়ন করার সৌভাগ্য ও সফলতার সমন্বয় করে আপনাকেও আরাফাতের ময়দানের মতো অন্য কোনো বরকতময় স্থানে নিমগাছের আবাদ করতে হবে। আর আপনি যদি জিয়ার স্মৃতিকে মানুষের মানসপট থেকে আপনার শুভকর্ম দ্বারা মুছে ফেলার ব্যাপারে সার্থকতা অর্জনের স্বপ্ন দেখেন, তাহলে আপনাকেও প্রয়াত হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ কোনো জীবিত লোক কোনো দিন মৃত লোকের সাথে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পারেনি। সফল মানুষের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা শুরু হয় মৃত্যুর পর। কারণ জীবিতকালের যেকোনো একটি ঘটনা যেমন তার সারা জীবনের সফলতাকে ম্লান করে দিতে পারে, তেমনি জীবনসায়াহ্নের একটি মাত্র কর্ম তার সারা জীবনের সব ব্যর্থতা, দুর্নাম ও বেদনার স্মৃতি মুছে দিতে সক্ষম।

পাঠকের মতামত: