ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ইলিশ মোবারক

indexআতিকুর রহমান মানিক :::

ঈদুল আজহার রেশ কাটেনি এখনো। তাই ঈদ মোবারক দেয়াই যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইলিশে সয়লাব হয়ে গেছে কক্সবাজারসহ সারাদেশ। তাই ঈদ মোবারক কনভার্ট হয়ে ইলিশ মোবারক হয়ে যাওয়ার দায় আমার নয়। বলতে গেলে এখন ইলিশময় কক্সবাজার।  হাটবাজার ছাড়াও প্রধান সড়ক, পাড়া মহল্লার পথে-ঘাটে চলছে ইলিশের ছড়াছড়ি ও বিকিকিনি। পর্যটন নগরীর অলি-গলিতে এখন ইলিশ রান্নার সুঘ্রাণ। গত এক সপ্তাহ ধরে কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে প্রচুর ধরা পড়ছে সুস্বাদু এ মাছটি। নুনিয়াছড়ায় অবস্হিত কক্সবাজার মৎস্য অবতরন কেন্দ্রে প্রতিদিন ভিড়ছে ইলিশ বোঝাই ফিশিং বোট। মাছ খালাস করা, বরফ দেয়া,  ওজন ও প্যাকিং করা, গাড়ীতে বোঝাই করাসহ হাকডাক ও ব্যস্ততার শেষ নেই। কক্সবাজারের ইলিশ ট্রাকবোঝাই হয়ে প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। আশি-নব্বই দশকের দিকে ইলিশ মাছ কক্সবাজারে সহজলভ্য থাকলেও মাঝখানে কিছুদিন দুস্প্রাপ্যতার খাতায় নাম উঠেছিল এর। কিন্তু দেশে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে ২০১১ সাল থেকে সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়। মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষনা ইনষ্টিটিউট ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন এসব কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে আসছে । আশ্বিন-কার্তিক মাস ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুম। এসময়  ডিমওয়ালা মা ইলিশ সংরক্ষণ ও অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে প্রতিবছর। প্রজনন মৌসুমে সাগর ও নদী মোহনার নির্দিষ্ট এলাকায় মাছধরা নিষিদ্ধকরন, হাটবাজারসমূহে নজরদারী ও ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান, জেলেদের উদ্ধুদ্ধকরন, সাগরে মাছধরা বন্ধে কোষ্টগার্ড ও নৌ বাহিনীর টহল ইত্যাদি কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে মা ইলিশের ডিম পাড়ার পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। এরপর ডিম থেকে নিষিক্ত রেনুপোনা ও জাটকা ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে জাটকা সংরক্ষণ কার্য্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে প্রতিবছর। এসব কর্মকান্ডে মৎস্য অধিদপ্তরীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুম হারাম হওয়ার যোগাড়। বিভিন্ন সময় এতে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, কোষ্টগার্ড,  ও সরকারী অন্যান্য সংস্হাকে। দেশব্যাপী উপকূলীয় এলাকায় গত অর্ধদশক ধরে পরিচালিত বিশাল এসব কর্মযজ্ঞের ফলে বেড়েছে উৎপাদন, নদী-সাগরে আকছার ধরা পড়ছে ইলিশ। ভোজন রসিক বাংলাদেশীদের (বাঙ্গালী নয়) পাতে তিনবেলা ইলিশ উঠার সোনালী দিন ফিরেছে আবার। কিন্তু সদ্যগত ঈদুল আজহার কোরবানীর মাংসে বাসার ফ্রীজ বোঝাই হয়ে থাকায় ইলিশ সংরক্ষণে সমস্যায় পড়ছেন অনেকে। কয়েকদিন আগে প্রমান সাইজের একটা ইলিশ চিরে শুকিয়েছিলাম। এই ইলিশ শুটকি রান্নার সময় ঘ্রানেই বাজীমাৎ, খাওয়ার সময় ইউনিক টেষ্ট। জাতীয় মাছ সু-স্বাদু ইলিশ সম্পর্কে যৎসামান্য আলোকপাত করতেই ঈদ মোবারকের পরিবর্তে এ “ইলিশ মোবারক”।
ইলিশ মাছ একক প্রজাতি হিসেবে সর্ববৃহৎ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে একক ভাবে ইলিশের অবদান শতকরা ১৩-১৫ ভাগ। এর বার্ষিক গড় উৎপাদন প্রায় ৩.৫ লক্ষ মেট্রিক টন, যার মূল্য প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। জি.ডি.পি-তে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ২.০%। জাতীয় রপ্তানী আয়েও ইলিশ মাছ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতি বছর ইলিশ মাছ অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে প্রায় ১’শ কোটি টাকারও বেশী বৈদেশিক মূদ্রা অর্জিত হয়। কর্মসংস্থানেও ইলিশ মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের ৪০টি জেলার প্রায় ১৪৫টি উপজেলার ১৫০০ ইউনিয়নের ৪ লাখ ৫০ হাজার জেলে ইলিশ মাছ ধরে থাকে। ইলিশ ধরা ছাড়াও বিপনন, পরিবহণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানী, জাল-নৌকা তৈরী ইত্যাদি কাজে সার্বিক ভাবে প্রায় ২৫-৩০ লক্ষ লোক জীবন-জীবিকার জন্য এ মাছের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশ মৌসুমে কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি ফিসারী ঘাট) থেকে ইলিশ মাছ বোঝাই করে প্রতিদিন শত শত গাড়ি দেশের বিভিন্ন স্থানে রওয়ানা হচ্ছে। বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সু-স্বাদু মাছ ইলিশ। ইলিশ মাছ খাদ্যমানেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ মাছে উচ্চ মাত্রায় আমিষ চর্বি ও খনিজ-পাদার্থ পাওয়া যায়। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় ৫০% অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এ্যসিড থাকে। উক্ত অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এ্যসিডের প্রায় ২% ওমেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিড, যা মানুষের দেহের রক্তের কোলেসটেরলের মাত্রা হ্রাস করে ও হৃদরোগ উপশম করে। ইলিশ মাছের আমিষে ৯ ধরণের এ্যামাইনো এ্যাসিড পাওয়া যায়,যা মানুষের পাকস্থলী উৎপাদন করতে পারে না। এছাড়া ইলিশ মাছে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ইত্যাদি। ইলিশের তেলে উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন এ ও ডি থাকে এবং কিছু বি ও মেলে। ইলিশ মাছের যকৃতে ১২০ আই,ইউ পর্যন্ত ভিটামিন এ পাওয়া যায়। এ মাছের কিছু ঔষুধি গুণও আছে। ইলিশ মাছে গড়ে ৫৩.৭ ভাগ পানি, ১৯.৪ ভাগ চর্বি, ২১.৮ ভাগ আমিষ এবং অবশিষ্ট পরিমাণ খনিজ পদার্থ থাকে। ইলিশ হতে প্রায় ৬০% খাবার উপযোগী মাছ পাওয়া যায়। ইলিশের স্বাাদ ও গন্ধ মাছের তৈলের উপর নির্ভরশীল। এর দেহস্থ সুঘ্রাণ এবং ভাজার সময়ও অসাধারণ ঘ্রাণ আশপাশের উল্লেখযোগ্য দূরত্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইলিশ নিঃসৃত এ সুগন্ধি পার্থিব অনেক সুগন্ধিকে হার মানায়। প্রাচীন বাংলা সংস্কৃত সাহিত্য এবং লোকজ সংস্কৃতিতে ইলিশ মাছের স্বাদ খাওয়ার পদ্ধতি এবং সংরক্ষণের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য দিক-নিদের্শনা পাওয়া যায়। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ইলশে গুড়ি কবিতা এখনো আমাদেরকে আলোড়িত করে। প্রাচীন কালের লোকজনের বিশ্বাস ছিল যে আশ্বিন- কার্তিক মাসের দূর্গা পুঁজার দশমীর দিন হতে মাঘ-ফাল্গুন মানের শ্রী পঞ্চমী পর্যন্ত ইলিশ মাছ ধরা এবং খাওয়া বন্ধ রাখা হলে এ মাছ বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে প্রায় সারা বছর কম-বেশী ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। তবে ইলিশ মাছ ধরার প্রধান মৌসুম হচ্ছে প্রতিবছর আগষ্ট হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। এ তিন মাসে গড়ে প্রায় ৬০% ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। প্রায় সারা বছর কম-বেশী প্রজনন করে থাকলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ প্রজনন করে থাকে ইলিশ মাছ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের ভরাপূর্ণিমা ও আমাবস্যার জোয়ারের সময় পরিপক্ক ও ডিম পূর্ণ মা-ইলিশ মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজনন এলাকায় প্রবেশ করে থাকে। ইলিশের প্রজনন নিশ্চিত করতে এসময় মা-মাছ আহরণ বন্ধ রাখার জন্য সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।  ইলিশ মাছের কৌটজাতকরণ বা ক্যানিংয়ের ফলাফল অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষনা ইনষ্টিটিউট এর নদীকেন্দ্রে পরীক্ষামূলক ভাবে উচ্চ চাপ এবং তাপপ্রয়োগে এ মাছকে কাটামুক্ত করে সফল ভাবে কৌটাজাত করা হয়েছে। উক্ত কৌটাজাতরকণ পদ্ধতি বাণিজ্যিক ভাবে প্রচলন করা সম্ভব হলে কৌটাজাত মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশি মূদ্রা আয়ের পথ সুগম হবে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইত্যাদি দেশে ইলিশ মাছের লবণাক্ত ডিমের ব্যাপক চাহিদা এবং উচ্চ বাজার মূল্য রয়েছে (প্রতি কেজি ৮০-৯০ আমেরিকান ডলার)। ইলিশ মাছের লবণাক্ত ডিম প্রস্তুত করে রপ্তানি করা হলে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মূদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। এ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারলে ভবিষ্যতে রপ্তানী করা যাবে। এবছর আগামী ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হবে আশ্বিণী পূর্ণিমার ক্ষনগননা। প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশের ডিমছাড়ার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও শুরু হবে মহাযজ্ঞ। তবে মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম অন্যান্য বছর ১৫ দিন চললেও এ বছর এর পরিধি ২২ দিন হতে পারে বলে জানা গেছে। ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে সরকারী উদ্যোগে বিগত কয়েকবছর ধরে পরিচালিত ব্যাপক কর্মযজ্ঞের যে সুফল এখন জাতি পাচ্ছে, তা যেন অব্যাহত থাকে। জেলে, মৎস্যজীবি, ভোক্তা ও সর্বশ্রেণীর জনগন আজ সচেতন। ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে সরকারী উদ্যোগকে সফল করতে এতে জনসম্পৃক্ততা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। সবাইকে আবারো ইলিশ মোবারক।

=================
আতিকুর রহমান মানিক,
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী,
মোবাইল- ০১৮১৮-০০০২২০
ই মেইল – newspark14 @gmail.com

পাঠকের মতামত: