ঢাকা,বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

চকরিয়াসহ কক্সবাজারে জঙ্গি অর্থায়নে কোরবানির মাংস বিতরণ!

%e0%a6%97%e0%a6%b9%e0%a6%97%e0%a6%97%e0%a6%97%e0%a6%97নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার :::

এবারের কোরবানির ঈদেও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে বিদেশি এনজিওর জঙ্গি অর্থায়নে মাংস বিতরণ করা হয়েছে। চকরিয়ায় তুরস্কের বেশ কয়েকজন নাগরিকের উপস্থিতিতে গরু জবাই এবং মাংস বিলির চিত্র ধারণ করতে গেলে বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কয়েকজনের মোবাইল ফোনসেট কেড়ে নিয়ে তোলা ছবি ডিলিট করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট লোকজন। এতে রহস্য আরো ঘনীভূত হয়েছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বিষয়টি জানার পর মাঠ পর্যায়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার সদর, উখিয়ার কুতুপালং, টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়াসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ঈদের পরদিন গরিব ও দুস্থ লোকজনের মধ্যে গরুর মাংস বিতরণ করা হয়। মূলত এই মাংস বিলি করা হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন চলা তুরস্কভিত্তিক এনজিও আইএইচএইচের (ইনসান হক ভি হুরিয়েতলারি ইনসানি ইয়ারদিম ভাকভি) ও আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) অর্থায়নে। বিদেশি এসব সংস্থা স্থানীয় এনজিও এবং প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ঈদের পরদিন অন্তত দুই শতাধিক গরু জবাই করে।

কক্সবাজার সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মাংস বিতরণ করা হয় স্থানীয় এনজিও পালসের ব্যানারে। ঈদের আগের  দিন রামুর গর্জনিয়া বাজার থেকে এনজিওটির নির্বাহী পরিচালক ১০টি গরু কেনেন। পালসের নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিম এর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ২৫০টি পরিবারের মধ্যে মাংস বিতরণ করা হয়েছে। গরু কেনার টাকা দিয়েছে ফ্রান্সের সংস্থা ‘বানি স্ট্রিট’।

চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী, খুটাখালী, ডুলাহাজারা, হারবাং ইউনিয়ন ও পৌরসভার ঘনশ্যাম বাজারেও একইভাবে মাংস বিতরণ করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।

ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ডেইলপাড়ায় একসঙ্গে জবাই করা হয় অন্তত ২০টি গরু। এ সময় তুরস্কের অন্তত পাঁচজন নাগরিক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের স্থানীয়রা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “গরু জবাই ও মাংস বিতরণের সময় একটি ব্যানার ব্যবহার করা হয়। তাতে ‘আইএইচএইচ’, ‘আরএসও’ এবং ‘আরাকান’ লেখা দেখতে পেয়ে আমাদের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধে। ওই কর্মকাণ্ডের চিত্র ধারণ করতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বাধা দেন এবং হুমকি দিয়ে বলেন, ছবি তুললে এলাকা থেকে তাঁদের বের করে দেওয়া হবে।”

ফাঁসিয়াখালীর কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করেন, ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য (মেম্বার) ও বিএনপি নেতা আবুল হাসেমের ভাই মৌলভি নুরুল আমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। গত বছর নুরুল আমিনের তত্ত্বাবধানে মাংস বিতরণ করা হলেও এবার তিনি ছিলেন না। তাঁর ভাই আবুল হাসেম মাংস বিলি করেন।

 

এ ব্যাপারে আবুল হাসেম বলেন, ডেইলপাড়ায় এসব গরু জবাই করা হয়। এ সময় তুরস্কের নাগরিকরাও উপস্থিত ছিলেন।

ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, বিদেশি এনজিওর অর্থায়নে ফাঁসিয়াখালীতে মাংস বিতরণ করা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। বিষয়টি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও জানে।

একই দিন হারবাং ইউনিয়নে মাংস বিলি করে বিদেশি সংস্থা ওয়ামি (ওয়ার্ল্ড অ্যাসেম্বলি অব মুসলিম ইয়ুথ)।

হারবাং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান বলেন, ‘ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি গ্রামে বিদেশি এনজিওর অর্থায়নে হাজারো পরিবারের মধ্যে মাংস বিতরণ করা হয়েছে বলে শুনেছি। আজ (গতকাল) বিষয়টি জানার পর স্থানীয় মেম্বার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে কৈফিয়ত চেয়েছি।’

চকরিয়ায় বিদেশি এনজিওর অর্থায়নে মাংস বিলির খবর একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরাও জানেন। চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘চকরিয়ায় মাংস বিতরণের বিষয়টি আমি জানতাম না। কোনো এনজিও রিলিফ বা সহায়তা দিতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে কেউ অনুমতি নেয়নি। তা ছাড়া যেসব বিদেশি সংস্থা এ কাজ করেছে তাদের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিদেশি এসব এনজিওর সঙ্গে কাদের যোগাযোগ আছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘জঙ্গি অর্থায়ন রোধে সরকার জিরো টলারেন্স অবস্থানে। সে ক্ষেত্রে বিদেশি এসব এনজিওর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে বিতর্কিত বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে বিভিন্ন স্থানে মাংস বিতরণ করা হয়েছে বলে আমি শুনেছি। বিষয়টি জানার পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত শুরু করেছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উল্লেখ্য, গত বছরও তুরস্ক, ফ্রান্সসহ বিদেশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থা জেলার বিভিন্ন স্থানে মাংস বিতরণ করে। কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে এসব এনজিও জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদেরও কৌশলে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত মাসে টেকনাফের শাপলাপুর বাজার থেকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আরএসওর সামরিক কমান্ডার হাফেজ ছলাউলসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় ১০ জনকে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভি রফিক আহমদ, বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মৌলভি আজিজ আহমদ।

 

পাঠকের মতামত: