ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

তালাকের ভয়ঙ্কর থাবা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে

divorceপ্রবাসে সংসার ভাঙনের পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। স্বপ্নের দেশে এসে সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং সন্তানকে নিরাপদে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রত্যাশা এভাবেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে অনেক বাংলাদেশির। আর অধিকাংশ তালাকের ঘটনায় ঘটছে মামুলি কারণে। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবাকেও দায়ী করা হচ্ছে এহেন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়ার জন্যে। গত এক দশকে যতগুলো তালাকের ঘটনা ঘটেছে, তার সিংহভাগই স্ত্রীর পক্ষ থেকে উদ্ভব হয়। তালাকের পর নিজেদের ভুল ভেঙে যাওয়ায় সামান্য কটি সংসার আবার জোড়া লেগেছে। তবে তালাকপ্রাপ্ত পরিবারের সন্তানেরা কেউই প্রত্যাশিত সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়নি। উত্তর আমেরিকায় বাংলা ভাষার সর্বাধিক প্রচারিত ‘ঠিকানা’ পত্রিকায় অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বাংলাদেশিদের মধ্যে তালাকের ঘটনা বৃদ্ধির চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

এক যুগেরও অধিক সময় ধরে নিউইয়র্কে কর্মরত এটর্নি অশোক কর্মকার বলেন, ‘অনেকে সিটিজেন হবার পর বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করেন। এরপর স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর অনেকের সাথে মনোমালিন্য দেখা দেয়। কারণ যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন, বাস্তবে তার কিয়দংশ দেখতে না পেরে মনোক্ষুন্ন হওয়ায় বেশ কিছু সংসার টিকেনি। আবার এমনও রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন পাওয়া পর্যন্তই স্বামীর সাথে ছিলেন কেউ কেউ। এরপর চলে গেছেন আপন গন্তব্যে।’

অশোক কর্মকার বলেন, ‘অপ্রিয় হলেও সত্য যে, অনেক মা-বাবা নিজেদের স্বার্থে পুত্র-কন্যার সংসারে ভাঙন ধরিয়েছেন। এসব মা-বাবা প্রবাসে আসার পর কারো সাথে কথা বলার সুযোগ পান না। বাইরে একাকী যেতেও পারেন না। অপরদিকে, পুত্র/কন্যাকে দেখেন কঠোর শ্রম দিতে। তারা অনেকেই ভাবেন, কন্যাটি এত পরিশ্রম করছে তার স্বামী আর সংসারের জন্যে। কিন্তু তারা সে অর্থের হিস্যা বা সম্মান পাচ্ছেন না (তাদের ভাবনা অনুযায়ী)। এরপর তারা পর্যায়ক্রমে মেয়েকে এতটাই ক্ষেপিয়ে তোলেন স্বামীর বিরুদ্ধে যে, সংসার ভেঙে যায়। এরপর ওইসব মা-বাবা দেশে নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেন আবারও। বিনিময়ে জামাই পক্ষের কাছে থেকে মোটা অর্থ পান। যদিও এ ধরনের বিয়ের স্থায়িত্ব দ্বিতীয় জামাইয়ের গ্রিনকার্ড পাওয়া পর্যন্তই।’

এটর্নী কর্মকার জানান, বাংলাদেশে অধিকাংশ নারীই গৃহবন্দির মত জীবন-যাপন করেন। পুরুষের ইচ্ছায় তারা চলাফেরা করেন। তেমন একটি পরিবেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর সেই নারীরা ৯১১’এর দাপট দেখাতে চান। প্রথম দিকে তারা এই নম্বর ঘুরিয়ে টেস্ট করার কথা ভাবেন। এরপর মামুলি ব্যাপারেই পুলিশ ডেকে স্বামীকে শায়েস্তা করার কথা ভাবেন। থানা-পুলিশ হবার পর স্বাভাবিকভাবেই স্বামী কম্যুনিটিতে নিগৃহিত হবার শংকায় থাকেন। কেউ কেউ নাক ছিটকায় যে, বউ পিটিয়ে হাজত খেটেছেন। এমন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেও অনেক সংসার ভেঙেছে।

গত ২৫ বছরে দৈনিক গড়ে একটি করে বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন জ্যাকসন হাইটসের ‘নিউইয়র্ক কাজী অফিস’র ইমাম কাজী কাইয়্যুম। তিনি বলেন, তালাকের সংখ্যা খুব কম। যেগুলোর সংবাদ পাই বা আমার কাছে আসেন, সেগুলোর অধিকাংশই মানসিক বিকারগ্রস্ত বলে মনে হয়েছে। আর ১৫% এর কাছে জেনেছি স্বামীর বিরুদ্ধে যৌন অক্ষমতা এবং ১০% জানিয়েছেন আর্থিক অসামর্থ্যের কথা। নিতান্তই নগণ্যসংখ্যকের সংসার ভেঙেছে পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দেহ আর অবিশ্বাসকে ঘিরে। আর এসব অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের কারণে মারপিটের উদ্ভব হয়ে হাজতবাসের ঘটনাও রয়েছে বেশ কিছু।

ইমাম কাইয়্যুম বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে যাবার ভয়ংকর একটি প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। অর্থাৎ যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকায় এসেছেন, তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এটি সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

প্রায় ১০ বছর যাবত তালাক সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে কাজ করছেন ব্যারিস্টার ইসরাত সামী। তিনি বলেন, আমার কাছে যারা এসেছিলেন তাদের প্রায় সকলেই পরস্পরের চরিত্র নিয়ে অভিযোগ করেছেন। অর্থাৎ একজন আরেকজনের অগোচরে অন্য নারী/পুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়েছেন। আর এমন অভিযোগ উত্থাপনকারী নারীর প্রায় সকলেই বিয়ের সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন।

ব্যারিস্টার সামী বলেন, আবার এমনও অভিযোগ উঠে যে, স্ত্রীরা নিজের ইচ্ছামত বাসার বাইরে যাবার অনুমতি পাচ্ছেন না। বিশেষ করে, যে সব পরিবারে শ্বশুর-শাশুড়ি বা ননদ-দেবর রয়েছেন, সেখানকার বধূরা এমন পরিস্থিতির পাশাপাশি দৈহিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে। ব্যারিস্টার সামী আরও বলেন, দেশ থেকে আসার সময় কন্ডিশনাল গ্রিনকার্ড পান এবং তার মেয়াদ দু’বছর। কোন কোন স্ত্রী দু’বছরের এ বিধির অপেক্ষায় থাকতে চান না। তারা স্বামী এবং অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অকথ্য অভিযোগ করে পুলিশ ডাকেন। এর জের ধরেই দু’বছরের আগেই সংসার ভেঙে গেছে অনেকের।

এদিকে, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আলেক্সান্দ্রা কিলেওয়াল্ড পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে উদঘাটিত হয়েছে যে, আর্থিক অবস্থা সংসার ভাঙতে প্রভাবিত করে না। এটি হচ্ছে মানসিক অবস্থার নিষ্ঠুর পরিণতি। ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়েসী ৬৩০০ দম্পতির ওপর এ জরিপ চালানো হয় এবং তা প্রকাশ পেয়েছে আগস্ট সংখ্যা ‘আমেরিকান সোস্যালজিক্যাল রিভিউ’তে। ‘মানি, ওয়ার্ক, এ্যান্ড ম্যারিটাল স্ট্যাবিলিটি : এসেসিং চেইঞ্জ ইন দ্য জেন্ডার্ড ডিটার্মিনেন্টস অব ডিভোর্স’ শীর্ষক এ জরিপে অংশগ্রহণকারিদের দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। ১৯৭৪ সালের আগে বিয়ে হওয়া দম্পতি এবং ১৯৭৫ সালের পর বিয়ে হওয়া দম্পতিদের কাছে থেকে প্রাপ্ত তথ্যের পর্যালোচনা করা হয়। সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতির কারণেও সংসার ভাঙার নজির পাওয়া গেছে।
জরিপকারী ড. আলেক্সান্দ্রা বলেন, ‘আমার সাধারণ পরামর্শ হচ্ছে, আর্থিক ব্যাপারটি কোনভাবেই প্রভাব ফেলে না সংসার ভাঙা আর না ভাঙার ওপর। এর পরিবর্তে দম্পতির পেইড অথবা আনপেইড ওয়ার্কের (কাজ করে কত অর্জিত হলো) প্রসঙ্গ তালাকের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

জরিপে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের আগে বিয়ে হওয়া দম্পতির মধ্যে স্ত্রীদের গৃহবধূ হিসেবে বাসায় কাজকর্ম করার প্রবণতাই বেশী। এ সময়ের দম্পতির মধ্যে তালাকের ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম। অপরদিকে, অতি সম্প্রতি বিয়ে হওয়া গৃহিনীর মধ্যে শুধু বাসায় কাজের প্রতি আগ্রহ কম। তবে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে ভাগাভাগী করে কাজে বেশি আগ্রহী। যদিও বাসায় কাজের প্রায় ৭০% করছেন গৃহবধূরাই। জরিপে আরও উদঘাটিত হয় যে, সনাতনী ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে উঠছেন পুরুষরা। স্ত্রীর অনেক কাজেই তারা পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।

জরিপে আরও দেখা যায়, ১৯৭৪ সালের পর বিবাহিতদের মধ্যে যারা ফুলটাইম চাকরি করেন না কিংবা ঘর-কাজেও অংশীদার হতে চান না, তাদের ভাগ্যে তালাকের নোটিশ বেশি আসছে। এ শ্রেণির দম্পতির মধ্যে স্বামীর ফুলটাইম চাকরিকেই একমাত্র অবলম্বন মনে করা হচ্ছে বিয়ে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে। তবে, যে সব পুরুষের ফুলটাইম চাকরি নেই, তাদের সংসার ঝুঁকিতে থাকে।

এ জরিপে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিয়ে ভাঙার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উদঘাটিত হয়েছে।  তা হচ্ছে ইমিগ্রেশনের ফায়দা এবং ফেডারেল অনুদান। নির্যতিনের শিকার নারীরা খুব দ্রুত গ্রিনকার্ড পেয়ে থাকেন। একইসাথে তারা গৃহায়ণের সুযোগও পান। রয়েছে ফুডস্ট্যাম্পের ব্যবস্থা। এসব ব্যবস্থা থাকায় অনেক নারী মামুলি কারণেই তালাকের মত চরম পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন।

পাঠকের মতামত: