ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

কেরামত আলীর মিউজিক্যাল কনসার্ট

cnআতিকুর রহমান মানিক :::

ছা-পোষা আটপৌরে ধরনের মানুষ কেরামত আলী। অযথা কোন ঝামেলায় না জড়িয়ে নিজের মত করে চলতেই অভ্যস্ত সে। তাই একান্ত নিজস্ব পরিমন্ডলের বাইরে তার চলাফেরা কম বললেই চলে। বাসা থেকে অফিস ও অফিস শেষে আবারো বাসায় ফেরা, এর  মধ্যেই তার বিচরন। অথচ ছাত্রজীবনে ভীষন ডানপিটে স্বভাবের ছিল সে। রকমারী দুষ্টামি-দুরন্তপনার জন্য স্যারদের কত বকুনি ও বেত হজম করতে হয়েছে তাকে। তবে লেখাপড়ায় ভাল ছিল বলে তার অনেক দস্যিপনা ক্ষমা করতেন শিক্ষকরা। এককালের দুরন্ত কেরামত এখন শান্তশিষ্ট নিরেট ভদ্রলোক। কিছুদিন আগে সৈকতপাড়ের তারকা মানের একটি হোটেলের বলরুমে অনুষ্ঠিত প্রোগ্রামশেষে  মিউজিক্যাল কনসার্ট দেখার সময় মিশ্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল সে। সেদিন  প্রোগ্রাম ও খাওয়া দাওয়া শেষে শুরু হল কনসার্টের বিরাট আয়োজন। বিশাল মঞ্চের দুই পাশে কাল রঙ্গের ৮/১০ টি বিরাট আলমিরা বসানো হয়েছে। গানের সাথে আলমিরার সম্পর্কের হিসাব মিলাতে না পেরে পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করে জানল এগুলো নাকি সাউন্ড বক্স! মঞ্চের চারদিকে বিদ্যুৎ সাবষ্টেশনের মত স্টীল স্ট্রাকচারে রাজ্যের হাবিজাবি তার ও লাইট ফিট করা। এ ছাড়াও মঞ্চের উপরে কয়েকসেট কি বোর্ড, লীড গিটার, বেস গিটার, ড্রামসেট, স্পীকার, এম্প্লিফায়ার, ও অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট ঠিক করতে কয়েকজনের গলদঘর্ম ছুটাছুটি দেখে তার করুনা হল। ইয়া বড় একতোড়া তারের বিভিন্ন প্রান্ত একবার এখানে লাগায় তো আরেকবার ওখানে খোলে। এভাবে অনেক্ষন করার পর স্পীকার হাতে নিয়ে স্টেজে দাড়িয়ে ফাটা গলায় বারবার চেক, চেক, চেক বলতে লাগল। কেরামত মনে করল এবার বুঝি তাদেরকে চেক করা হবে, নিজের অাশেপাশে নিষিদ্ধ কিছু আছে কিনা সন্তর্পনে দেখে নিল সে। কিন্তু এরপরেও অনেক্ষন চেক, চেক শব্দ উচ্চারণ করতে থাকল মঞ্চের কয়েকজন, কিন্তু গান শুরু করার কোন লক্ষন নেই । এই চেকের বাহারের ব্যাপারে পাশের ছোকরা বলল এটা নাকি ইন্সট্রুমেন্ট ও লাইটিং সিষ্টেম  চেকিং। ওমা আরো কত কান্ড দেখতে হবে কে জানে, মনে মনে বলে কেরামত। এভাবে দুইঘন্টাখানেক চলার পর মঞ্চে স্পট লাইট, ফ্লাড লাইট ও ডিসকো লাইট সহ হরেক ধরনের ডজনখানেক লাইট জ্বলে উঠল। এসময় জীর্ণ মলিন ও জোড়াতালি দেয়া জিন্স প্যান্ট ও ছেড়া খাটো টি-শার্ট পরনে এলোমেলো চুলের এক ভিক্ষুক হঠাৎ মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিল। বিষ্ময়ের ঘোর কাটতেই কেরামত শুনল এটা নাকি উপস্হাপক, কিন্তু পোশাক-আশাক দেখে তাকে ভিখারী মনে করবে যে কেউ। জোড়া তালি দেয়া ছেঁড়াফাটা এসব কিম্ভুতকিমাকার রঙ-বেরঙ পোশাক নাকি হালফ্যাশনের অংশ! যাই হোক, উপস্হাপক (!) কনসার্ট শুরু করার ঘোষনা দিলেন, কিন্তু এতক্ষন দেরী করার কোন কৈফিয়ত দিলেননা। এরপর হঠাৎ জটা চুল, রং উঠা পুরনো ময়লা পোশাক, হাতে লোহার বালা ও গলায় ডুমুরের মালা পরা অদ্ভুত এক পাগল ষ্টেজে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিল। এতক্ষন পাগল মনে করলেও গান শুরু হওয়ার পর কেরামত বুঝল এটা আসলে শিল্পী ! জটা চুল, দীর্ঘদিন না ধোয়া ময়লা পোশাক, হাতে মাস্তানদের মত লোহার বালা, রং দেয়া লম্বা নখ ও গলায় আদিম মানুষের মত শুকনো ডুমুরের মালা না থাকলে নাকি আজকাল শিল্পী হওয়া যায়না। যাই হোক শিল্পী মহোদয় গান শুরু করলেন। গানের কি ছিরি, বাজনার বিকট শব্দে গানের কোন কথাই বুঝা গেলনা। শুধু বাদ্যযন্ত্রের কানফাটানো তাল। এখানে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, গানের বাজনার সাথে সাথে শিল্পী উৎকট অঙ্গভঙ্গির সাথে ব্যাঙের মত তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে, সাথে দর্শক-শ্রোতা একদল ছোকরাও ধেই ধেই করে নাচছে। কোমর দুলিয়ে, অঙ্গভঙ্গি করে সে কি বেশরম নাচ, দেখলেই ঘেন্না লাগে। কেরামত আলী সামনের দিকে থাকায় দেখল, তার চারপাশে সবাই নাচের নামে ফড়িংয়ের মত লাফাচ্ছে। কানফাটানো বিকট বাজনার সাথে নাচে অংশ না নেয়ায় তাকে সেকেলে ও গেঁয়ো বলে বিদ্রুপ করল কয়েকজন। অবশেষে কেরামত নিজেও কয়েকটা লাফ দিয়ে দিল। প্রথম শিল্পী বেচারা হয়রান হয়ে নেমে গেলে হ্যাংলা একটা মহিলা শিল্পী মঞ্চে উঠে এল। মহিলার রুচি আছে বলতে হবে। পরিপাটি করে আঁচড়ানো ও পিঠে ছড়িয়ে রাখা লম্বা কালো চুল, কানে ছোট্ট এয়ারিং, মুখে মার্জিত মেক-আপ, ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক ও নেলপালিশ মিলিয়ে বেশ মার্জিত বেশভূষা তার। কিন্তু পরনে জিন্সের প্যান্ট, সামান্য লম্বা ফতুয়া ও বেঢপ টাইপের সানগ্লাসটা একটু বেমানান ঠেকছে। কিন্তু গানের আগে মহিলা শিল্পী কথা শুরু করতেই ভূল ভাঙ্গল কেরামত আলীর। কন্ঠ শুনে বুঝল আসলে এটা পুরুষ, বেশভূষা দেখে যদিও মহিলা মনে করেছিল সে। আসলে এখনকার ছেলেদের রুচিবোধ দিন দিন কোথায় যে নেমে যাচ্ছে, এ নিয়ে আফসোস হল তার। যাই হোক, দ্বিতীয় শিল্পী গান শুরু করার পর ষ্টেজে হঠাৎ মৃদু ধোঁয়া দেখা দিল। সেই ধোঁয়ার কুন্ডলী ক্রমে বিস্তৃতি লাভ করে গোটা মঞ্চকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তখন আগুন লেগেছে মনে করে চিৎকার শুরু করল কেরামত। ততক্ষনে নিজের অজান্তেই মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের নাম্বারে ফোন দিচ্ছিল সে। কিন্তু আশপাশের সকলকে স্বাভাবিক দেখে কেমন যেন খটকা লাগল তার। অবশেষে আয়োজকদের একজন তাকে বললেন, এ ধোঁয়া নাকি কৃত্রিম ধোঁয়া ও ষ্মোক মেশিনের সাহায্যে সৃষ্ট। গানের সাথে ধোঁয়ার কি সম্পর্ক, তা বুঝতে পারলনা কেরামত আলী।
কনসার্টের শুরু থেকে উপস্হাপক-গায়কদের কিম্ভুতকিমাকার বেশভুষা, গানের নামে বিকট চিল্লাচিল্লি-লাফালাফি ও অন্যান্য দুর্বোধ্য কর্মকান্ডের পর এখন ধোঁয়ার ব্যাপারটা কেরামত আলীর মেজাজটাই বিগড়ে দিল। কনসার্ট বাদ  দিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করল সে। হাঁটতে হাঁটতে কালজয়ী অনেক বাংলা গানের কথা মনে পড়ল তার। শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর কন্ঠে “একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়”, সৈয়দ আব্দুল হাদীর কন্ঠে “এমনতো প্রেম হয় চেখের জলে কথা কয়”, “আমি কার জন্য পথ চেয়ে রব আমার কি দায় পড়েছে”, তমি যে আমার কবিতা, শাকিলা জাফর ও তপন চৌধুরীর কন্ঠে “পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হৃদয় ভেঙ্গে যায় যাক তার করিনা ভয়”, “শুভ দা” ছবিতে সাবিনা ইয়াছমিনের কন্ঠে “শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে কত সাধনায় এমন ভাগ্য মিলে, মাসুম ছবিতে রুনা লায়লার কন্ঠে “চোখের পানি কেন ফুরায়না মাগো”, অথবা এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া “জীবনের গল্প আছে বাকী অল্প” সহ এরকম হাজারো চিরসবুজ গানের কথা মনে পড়ে তার। চিরসবুজ ও জীবনমুখী এসব গান যুগের পর যুগ অমর হয়ে আছে রুচিশীল শ্রোতাদের কাছে। হাল আমলের ব্যান্ড যুগের শুরুতেও সৃষ্টি হয়েছে রুচিশীল অনেক গান। সোলস ব্যান্ডের তপন চৌধুরীর গাওয়া “মন শুধু মন ছুয়েছে”, পার্থ বড়ুয়ার কন্ঠে “কেন এই নিঃসঙ্গতা”, দাঁড়াও পথিক, এলআরবি’র আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া “ঘুমন্ত শহরে”, রূপালী গীটার, মাইলসের শাফিন আহমেদের কন্ঠে “ফিরিয়ে দাও”, জ্বালা, ঢাকা ব্যান্ডের মাকসুদের গাওয়া “বাংলাদেশ হতে পারে গরীবের দেশ”, নগর বাউলের জেমসের কন্ঠে “জেল থেকে বলছি”, মা ও দুঃখিনী দুঃখ করোনাসহ এরকম মেলোডিয়াস আরো ব্যান্ডসঙ্গীত এখনো শ্রোতাদের হৃদয়ে জেগে রয়েছে। ছাত্রজীবনে পছন্দের এসব গানের ক্যাসেটের বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলেছিল কেরামত। কিন্তু টেপরেকর্ডার-ওয়াকম্যান-ক্যাসেট যুগের পর এমপি ত্রি-সিডি-ডিভিডি ও পেনড্রাইভ যুগ পেরিয়ে এখন মেমোরি কার্ড-ইউ টিউব যুগে এসে একদশক আগের সেই ক্যাসেটগুলোর প্রয়োজন এখন নেই বললেই চলে। তার শখের সনি ক্যাসেট প্লেয়ার ও ক্যাসেট গুলো এখন গ্রামের বাড়ীর ছোটদের অপ্রয়োজনীয় খেলনামাত্র। চিরসবুজ সব বাংলা গানগুলো এখন ইউটিউবে পাওয়া যায়। একান্ত অবসরে অথবা লংজার্নির সময় এসব গান শুনে নষ্টালজিক হয় কেরামত। আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সভ্যতার সোনালী ইতিহাসের স্বাক্ষী শ্রোতাপ্রিয় এরকম অনেক গান। কিন্তু এসব দুরে ঠেলে কি নিয়ে মগ্ন রয়েছে আমাদের ছাত্র-যুবকরা? গানের নামে, কনসার্টের নামে আজকাল কি হচ্ছে এসব ? কোথায় চলেছি আমরা ও আমাদের নবপ্রজন্ম? নিজকেই প্রশ্ন করে কেরামত। পাশ্চাত্যের আমদানী করা বিজাতীয় উৎকট সংস্কৃতি বাদ দিয়ে আমাদের তরুনরা নিজস্ব গৌরবময় কৃষ্টি-কালচার অনুসরন করবে, এমনটাই স্বপ্ন দেখে কেরামত আলী।
==================
আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী।
ই মেইল [email protected]
মুঠোফোন ০১৮১৮-০০০২২০

পাঠকের মতামত: