ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

চট্টগ্রামের ট্যানারি বন্ধ : কাঁচামাল সংকটে ১০ জুতা কারখানা

tenariসালমা ইসলাম, নিজস্ব প্রতিবেদক :::

কাঁচামাল সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে কম দাম ও রপ্তানিতে ইমেজ সংকটে চট্টগ্রামের শতভাগ রপ্তানিমুখী ১০ জুতা কারখানা। চলতি সময়ে নানা সংকটের মধ্যে এই বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলো (ট্যানারি) একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এ আশংকা আরো প্রকট হয়ে উঠেছে বলেও জানান তাঁরা। এই ১০ জুতা কারখানায় ৭০ শতাংশের বেশি কাঁচামাল সরবরাহকারী নগরীর দুইটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানা (ট্যানারি) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ সংকট হওয়ার আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য ঢাকা ও বিদেশমুখিতা বাড়বে। সেই সাথে বেড়ে যাবে জুতার উৎপাদন খরচ। যার কারণে বাজার হারানোর শঙ্কায় জুতা ব্যবসায়ীরাও।

কোরবানির ঈদ যতই সামনে আসছে এ সংকটের আশংকা ততই ঘনীভূত হচ্ছে। এরই মধ্যে সংকটের আশু সমাধান করে চামড়া ও জুতা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে রক্ষার দাবি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আড়তদার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির। আগামী শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে সম্প্রতি বন্ধ করে দেয়া ট্যানারি দুইটি অন্তত: সামনের কোরবানির চামড়া সংগ্রহ পর্যন্ত খুলে দেয়ার দাবি জানাবেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সংগঠনের নেতা মুসলিম উদ্দিন এক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম বৈষম্যের শিকার বলে উল্লেখ করে বলেন, ইটিপির কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সর্বশেষ মদিনা ও রিফ ট্যানারি দুইটি বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ এর মধ্যে রিফ ট্যানারিতে ইটিপি বসানোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। আর ঢাকার হাজারিবাগে ট্যানারিগুলো চলছে ইটিপি ছাড়াই। যদিও ঢাকার ট্যানারি শিল্পের জন্য সাভারে সেন্ট্রালি একটি ইটিপি বসানোর কাজ চলছে।

মুসলিম উদ্দিন আরো বলেন, ঢাকায় ট্যানারি শিল্পের জন্য আলাদা জোন করে দেয়া হয়। ট্যানারি ব্যবসায়ীদের জন্য প্লট বরাদ্দও দেয় সরকার। সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে। অথচ চট্টগ্রামে দেশের সর্বোচচ চামড়া উৎপাদন হলেও এই খাতের ব্যবসায়ীদের কোন সুযোগ না দিয়ে শুধু ইটিপির জন্য দুইটি ট্যানারি বন্ধ করে দেয়া হল। এতে গত ২০/২৫ বছর ধরে এই পেশার নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত। চট্টগ্রামের ১০টি রপ্তানিমুখী জুতা কারখানায় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং চামড়া ব্যবসায়ীদের স্বার্থে অন্তত ইটিপি নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠানকে চামড়া কেনার সুযোগ করে দিলে এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বেঁচে যায়।

সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি চামড়া উৎপাদন হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলে। সারা দেশের উৎপাদিত কাঁচা চামড়ার মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ পাওয়া যায় এখান থেকে। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের ২২ টি ট্যানারি এসব কাঁচা চামড়া কিনে তা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতসহ রপ্তানিতে নিয়োজিত ছিল। আর্ন্তজাতিক বাজারে চামড়ার নিম্মমুখী দর ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পেরে লোকসানে পড়ে ২০১০ সালের মধ্যে ২০ টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে যায়। এতে চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে অবশিষ্ট মদিনা ও রিফ এ দুই ট্যানারির উপর। কেননা চট্টগ্রামের মোট চামড়ার প্রায় ৭০ শতাংশের বেশী কিনে নিতো এই দুটি কারখানা। আর চট্টগ্রামের রপ্তানিমুখী ১০ জুতা কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহের ৭০ ভাগের বেশী সামাল দিত এ দুই ট্যানারি। ট্যানারি দুইটি সচল না হলে এবার কাঁচামাল সংকটে পড়ার আশংকা জুতা কারখানাগুলোর।

প্রসঙ্গত: সর্বশেষ গত ১ আগস্ট ইটিপি না থাকার কারণে রিফ লেদার ট্যানারি বন্ধ করে দেয়া হলেও চট্টগ্রামের সবচেয়ে পুরাতন মদিনা ট্যানারি বন্ধ করা হয় কয়েকমাস আগে। জানা গেছে, দু’টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক বেকায়দায় পড়েছে চট্টগ্রামের প্রায় তিনশ’ আড়তদার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী। এখন চামড়া নিয়ে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের মুখাপেক্ষী হতে হচেছ। সরকারি ঋণ সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও ঢাকার ট্যানারি মালিকরা বাকিতে চামড়া কিনে থাকে। এখনো গত বছরের প্রায় ২৫ কোটি টাকা ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া পড়ে রয়েছে। আর চট্টগ্রামে সম্প্রতি বন্ধ করে দেয়া দুইটি ট্যানারি চামড়া কিনে নিত নগদ টাকায়। ব্যবসায়ীদের মন্তব্য, এটা চট্টগ্রামের প্রতি বৈষম্য কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।

তথ্য অনুযায়ী, উল্লেখিত ১০ জুতা কারখানার মধ্যে পতেঙ্গা ফুটওয়্যার, স্ট্রং ফুটওয়্যার, কসমস সুজ, বন্ড সুজ, ফাউলু সুজ ও টি কে ফুটওয়্যার লিমিটেড অন্যতম।

সিইপিজেডে অবস্থিত পতেঙ্গা ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপক (কোঅর্ডিনেশন) রাশিদুল হক বলেন, জাপানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পতেঙ্গা ফুটওয়্যারের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয় চট্টগ্রামের রিফ লেদার থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ কাঁচামাল ঢাকার ট্যানারি ও দেশের বাইরে থেকে আমদানি হয়। ইপিজেড ও সিইপিজেডের স্ট্রং ফুটওয়্যার, কসমস সুজ, বন্ড সুজ, ফাউলু সুজের অধিকাংশ কাঁচামাল রিফ লেদার থেকে সংগ্রহ করা হয়।

এবার চট্টগ্রামের ট্যানারি দু’টি বন্ধ হয়ে গেলে জুতা তৈরির কাঁচামালের জন্য তাদের ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হবে। এমনকি ভালো মানের চামড়ার জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এতে জুতা কারখানাগুলো পড়বে আরেক সঙ্কটে।

স্ট্রং ফুটওয়্যারের মহাব্যবস্থাপক শামীম আকবর চৌধুরী জানান, গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর এমনিতে বিদেশি ক্রেতারা এদেশ থেকে জুতা কিনতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। কারণ জুতা ও চামড়ার অধিকাংশ ক্রেতা জাপান, চীন, তাইওয়ান ও ইতালীয়। এ অবস্থায় যে কোন মূল্যে চট্টগ্রামে ট্যানারিগুলো সচল না থাকলে বড় পরিসরে চট্টগ্রামেরই ক্ষতি, দেশের ক্ষতি।

এ বিষয়ে ইতালিয়ান আরমানি জিন্স ও ডিয়াডোরা ব্রান্ডের জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কসমস সুজ। কিন্তু গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে কসমস সুজ প্রথম ধাক্কা খেয়েছে। এরপর চট্টগ্রামের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী দুটি ট্যানারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কাঁচামাল কিনতে খরচ বেড়ে যাবে। এতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে জুতা কারখানাগুলো সংকটের মুখোমুখি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ইটিপি ও সার্বিক ব্যবসা সম্পর্কে মদিনা ট্যানারি মালিক আবু মোহাম্মদ বেশ ক্ষোভের সাথে বলেন, ট্যানারির তরল বর্জ্য যাতে আশপাশের নালানদীতে না পড়ে সেই জন্য কারখানা সংলগ্ন একটি পুকুর খনন করেছি। তারপরও পরিবেশ অধিদপ্তর ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে। ইটিপি অত্যন্ত ব্যয় বহুল। একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, এই এলাকার অসংখ্য গার্মেন্টসের তরল বর্জ্য ওয়াশিং প্লান্টের বর্জ্যসহ বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা নালায় ও হালদা নদীতে পড়ছে। অথচ শুধু আমাদের ট্যানারিগুলো বন্ধ করে দেয়া হল। ব্যবসার জন্য ঢাকার ট্যানারি মালিকরা প্লট ও ব্যাংক ঋণ সুবিধা পায়। আমরা চট্টগ্রামের ট্যানারি মালিকরা কিছুই পাইনা। নিজেরা ব্যবসা করতে গেলে সেখানেও আসে নানা বিপত্তি।

এ বিষয়ে রিফ লেদার ট্যানারির পরিচালক (অপারেশন) মোখলেছুর রহমান জানান, রিফের ইটিপি নির্মাণ কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে আমরা এই সময়টুকু চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা গত ১ আগস্ট ফ্যাক্টরিতে তালা মেরে দিয়েছে। ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় এবার কোরবানির চামড়া ক্রয় করা সম্ভব হবে না।

তিনি আরো জানান, এ ইটিপি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এতে ৪২ কাঠা জায়গার ওপর এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ইটিপি প্রজেক্টটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হচ্ছে ২৫ কোটি টাকা। ছোটখাট ট্যানারি কিংবা কারখানার পক্ষে এটা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার সমন্বিত উদ্যোগ নিলে ঢাকার মতো একটি সেন্ট্রালি ইটিপি করতে পারে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আড়তদার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম, কবাজার ও তিন পার্বত্য এলাকার কাঁচা চামড়া নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় অবস্থিত প্রধান পাইকারি বাজারে সংগ্রহ করা হয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া কিনে পাইকারি বাজারে নিয়ে আসে। স্বাভাবিক অবস্থায় দৈনিক এক হাজার গরু ও মহিষের চামড়া এবং ৩৪ হাজার ছাগলের চামড়া বেচাকেনা হয়। তাছাড়া সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের মনসা পূজা উপলক্ষে বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রায় ৭০ হাজার পিস চামড়া পাওয়া গেছে। কোরবানির সময় চট্টগ্রামে ৪ লাখ গরুর চামড়া, প্রায় ২ লাখ ছাগলের চামড়া ও ১২/১৩ হাজার মহিষের চামড়া সংগ্রহ হয়ে থাকে।

পাঠকের মতামত: