ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

কী আছে নতুন বিদ্যুৎ আইনে?

11বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ রেখে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ আইন।। নতুন এই আইনে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ থাকছে। ১০৫ বছর পর এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎ আইন । এতদিন ইলেকট্রিসিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী দেশের বিদ্যুৎ খাত পরিচালিত হচ্ছিল।

১৯১০ সালের ১৮ মার্চ প্রণীত একটি আইন দিয়ে চলছিল বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত। সময় বদলেছে। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। তার পরেও গত ১০০ বছরে এ খাতের জন্য এরমধ্যে নতুন নতুন বিভাগ পরিচালনায় সাতটি পৃথক আইন করা হয়েছে। কিন্তু মূল বিদ্যুৎ আইন পরিবর্তন করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে জারি করা আলাদা নীতিমালা বা বিধিমালা দিয়েই মূলত বিদ্যুৎ খাত চলেছে। পুরো খাত নিয়ন্ত্রণে একক কোনও আইন না থাকায় নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমান সরকার এ খাতের জন্য একটি পরিপূর্ণ আইন করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করায় পুরনো আইনের আদলে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৃটিশ শাসনামলে করা আগের আইনটি ছিল ইংরেজিতে। এবার এটিকে বাংলায় করা হবে। পাশাপাশি নতুন কিছু ধারাও সংযোজন করা হবে। গত ৮ আগস্ট এআইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন পেয়েছে। চলছে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণের কাজ। এটি শেষ হলে পাসের জন্য জাতীয় সংসদে তোলা হবে নতুন বিদ্যুৎ আইন- ২০১৬। এর পর থেকেই নতুন করে চলবে দেশের বিদ্যুৎ খাত।

নতুন এই আইনের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, শত বছরের পুরনো আইন দিয়ে চলছিল দেশের বিদ্যুৎ খাত। দেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বেড়েছে দেশের আয়তন। একই সময়ে বদলেছে দেশের পরিধি। এতকিছুর পরেও সেই আইন দিয়েই চলছিল দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ খাত। বিদ্যুৎ খাতের সেবা, ব্যবসায়, গ্রাহক, উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থা সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেলেও আইনের কোনও পরিবর্তন হয়নি। সেজন্যেই এই নতুন আইন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খসড়া বিদ্যুৎ আইন ২০১৬-এ ৮টি অধ্যায় এবং ৭৬টি ধারা রয়েছে। আইনের প্রথম অধ্যায়ে শিরোনাম ও সংজ্ঞা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদির বিধান, তৃতীয় অধ্যায়ে পূর্ত কর্মকাণ্ডের বিধানাবলী, চতুর্থ অধ্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়াদি, পঞ্চম অধ্যায়ে সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিধান, সপ্তম অধ্যায়ে অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রয়েছে। আর অষ্টম অধ্যায়ে রয়েছে বিবিধ বিষয়াদি- যেমন বিরোধ নিষ্পত্তি, জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস, বিদ্যুৎ লাইসেন্সিং প্রতিষ্ঠানকে শ্রম আইনের আওতাবহির্ভূত রাখা।

নতুন এই আইন অনুযায়ী যে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। নিজস্ব স্থাপনায় ব্যবহারের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থায় বিতরণ লাইনও স্থাপন করতে পারবে। একইসঙ্গে সরকারি-বেসরকারি এসব স্থাপনা রক্ষায় নতুন আইনে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।

আইনের খসড়ায় বলা আছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে নাশকতা করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০ কোটি টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। নাশকতার উদ্দেশ্যে কেউ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, উপকেন্দ্র, বিদ্যুৎ লাইন, খুঁটি ও সঞ্চালন যন্ত্রপাতিতে কোনও বস্তু নিক্ষেপ করলে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। একইসঙ্গে এ ধরনের অপরাধে কেউ প্ররোচনা ও সহায়তা দিলে তার বিরুদ্ধেও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে অন্তর্ঘাতমূলক মামলা ও শাস্তি হবে। সরকারি কর্মচারী-বেসরকারি সংস্থা, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেলায়ও একই আইন প্রযোজ্য হবে। শুধু তাই নয়, এই আইনে অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিষয়টি ধামাচাপা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সংস্থার বিরুদ্ধেও প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হবে।

নতুন  বিদ্যুৎ আইনের আওতায় বিদ্যুতের চুরি শনাক্ত ও রোধে এবং বিদ্যুতের অপব্যবহার প্রতিরোধে দেশে কর্মরত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বিদ্যুৎ গোয়েন্দা সেল গঠন করার বিধান রাখা হয়েছে।

আইনের খসড়ায় ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করার কথা বলা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়েছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের জন্য। বিদ্যুৎ বিভাগে যেহেতু এখন শ্রমিক নেই, সবাই কর্মচারী, সেহেতু সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা উচিত নয়। ইউনিয়ন থাকায় বিভিন্ন কাজকর্মে জোর জবরদস্তি হয় এবং শৃঙ্খলা নষ্ট করার মতো ঘটনা ঘটে। মন্ত্রিপরিষদের ওই সভায় ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না বলে মত দেন একাধিক মন্ত্রী। ট্রেড ইউনিয়ন রাখার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে একজন সদস্য বলেন, এই সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করলে তার বাজে প্রভাব পড়বে। কেন এটা বন্ধ করা হয়েছে, সেটি না বুঝে দেশে-বিদেশে নানা রকম সমালোচনা হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, বিদ্যুতে ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টিই সরকার-সমর্থক। অতএব, এগুলো বন্ধ করার কোনও যুক্তি নাই। পরে প্রধানমন্ত্রী ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব বাদ রেখে নতুন বিদ্যুৎ আইনের খসড়া অনুমোদনের নির্দেশ দেন।

নতুন করা বিদ্যুৎ আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রাহককে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান, গুণগত মানের বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে সরকার বিদ্যুৎ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পুনর্বণ্টন করতে পারবে। বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনতে সরকার ইচ্ছা করলে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য এক বা একাধিক বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ বোর্ড বা হোল্ডিং কোম্পানি গঠন করতে পারবে। বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনে জাতীয় বিদ্যুৎ নীতি প্রণয়ন করতে পারবে। এই নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নসহ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। একইভাবে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। খসড়া আইনে অবৈধ বিদ্যুৎ বিতরণ বা ব্যবহারকারীকে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ১০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ চুরির জন্য তিন বছর, ১০ কিলোওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ চুরির জন্য ৫পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, এছাড়া ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলেও গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ ও সরবরাহ করার সুযোগ নেই। সঞ্চালন ও বিতরণ খাত দুটি এককভাবে পরিচালনা করছে দেশের রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানি ও বোর্ড। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে তা সঞ্চালন ও বিতরণ করছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো। নতুন আইন হলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেসরকারি খাতে লাইসেন্স দেওয়া হবে। সরকারের অনুমতি নিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিদেশে রফতানিও করতে পারবে। একইসঙ্গে বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে। এই আমদানি বা রফতানির জন্য বাংলাদেশের বিদ্যমান সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হবে ওই প্রতিষ্ঠানকে।

খসড়া আইনে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পরিদর্শনের জন্য দায়দায়িত্ব দিতে ‘প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শক’ পদ এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের পরিদর্শকের অধীন অন্যান্য কর্মচারীর পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনিকভাবে যে পাওয়ার সেল গঠন করা হয়েছে, সেটিকে নতুন এ আইনের আওতায় আনা হয়েছে। লাইসেন্সের সংজ্ঞায় সেকশন-২ এর সাব-সেকশন ১৮ সংযোজন করা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন লাইসেন্স প্রদান করবে।

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনও ব্যক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভূমির সঙ্গে সংযুক্ত (আর্থিং) করতে পারবে না।

জানা গেছে, পুরনো আইনে মোট ধারা আছে ৫৮টি। এতে লাইসেন্স দেওয়া, শাস্তি, উৎপাদন, সঞ্চালনসহ বিভিন্ন বিষয় আছে। যার বেশিরভাগই এখন অপ্রয়োজনীয়। ১৯১০ সালের আইনের ৩৯, ৩৯ (এ), ৪০, ৪০ (এ), ৪১, ৪২, ৪৩ ও ৪৪ নম্বর ধারায় বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে। এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত জেল হওয়ার নিয়ম আছে। সঙ্গে আছে এক হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানার নিয়ম। তবে বিদ্যুৎ চুরি, মিটার টেম্পারিংসহ বিভিন্ন কারণে সর্বোচ্চ শাস্তি আছে এক থেকে তিন বছরের জেল অথবা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা। অবৈধ ট্রান্সমিশনের জন্য পাঁচ থেকে ১০ বছর জেল অথবা প্রতিদিন এক হাজার টাকা জরিমানা।

২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ৬২ শতাংশ। অপরদিকে বেসরকারি খাতে বেড়েছে ১৬৯ শতাংশ। তবে নতুন আইনে বেসরকারি খাত কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রফতানি করবে তা স্পষ্ট করে দিতে হবে। সরকারি গ্রিড ব্যবহারের বিষয়টিও স্পষ্ট করতে হবে বলে জানা গেছে।

নতুন আইনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ  জানান, ‘দেশের উন্নয়নে বর্তমানে বিদ্যুৎ খাত  সব চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়ৈছে। এ অবস্থায় পুরনো আইটির পরিবর্তন সময়ের দাবি। কারণ, পুরনো আইনটির সীমাবদ্ধতা ও ফাঁকফোকর রয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে অনেকেই দুর্নীতি ও অপব্যবহার করে থাকে। এসব বন্ধ করার জন্যও নতুন আইন জরুরি।’ বাংলা ট্রিবিউন

পাঠকের মতামত: