ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

কোটি টাকা জেতার এসএমএস : প্রতারণার মহাফাঁদ

‘যুক্তরাজ্যের পেপসি কোম্পানির লটারিতে আপনার মোবাইল নম্বরটি ৮ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড জিতেছে। পুরস্কারের অর্থগ্রহণের জন্য আপনার নাম, বয়স, মোবাইল নম্বর উল্লেখিত ই-মেইলে পাঠান। ই-মেইল- ‘[email protected]

সম্প্রতি দেশের অনেক মোবাইল ব্যবহারকারীর কাছেই এ ধরনের এসএমএস আসছে। তবে কেউ এ এসএমএসের সাড়া দিলেই কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল অংকের অর্থ। এমনকি এ এসএমসের জবাব দিলে ব্যবহারকারীর কাছ থেকে কৌশলে তার আর্থিক লেনদেনের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ারও মহাফাঁদ পেতেছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে এমনই তথ্য জানা গেছে।

mobile

অনুসন্ধানে জানা যায়, সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ জন প্রতারক দেশের বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের গ্রাহকদের নম্বরে এ ধরনের এসএমএস দিচ্ছে। জবাব পেলে তারা ব্যবহারকারীর কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি হাতিয়ে নিচ্ছে তার আর্থিক ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও, যা দিয়ে ওই ব্যবহারকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টও (অনলাইন) হ্যাক করে ফেলতে পারে।

গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এ প্রতারক চক্রের সবাই বিদেশি নাগরিক। অর্ধেক নাইজেরিয়ান। বাকিরা ঘানা ও কেনিয়ার। চক্রটির সদস্যরা তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিশেষজ্ঞ এবং হ্যাকার। তারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের কয়েকজন খিলক্ষেতে, কয়েকজন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এবং কয়েকজন বারিধারার কূটনৈতিক এলাকায় থাকে। তারা গার্মেন্টসহ অন্যান্য ব্যবসার নামে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে।

গোয়েন্দারা জানান, এই তিনটি স্থান থেকেই প্রতারণামূলক এসএমএসগুলো দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন তারা। এসএমএস পাঠাতে প্রতারকরা ইন্টারনেট বা অন্য কোনো পদ্ধতি নয়, সরাসরি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনকৃত সিম ব্যবহার করছে। প্রতারকদের পাকড়াও করতে তৎপরতা চলছে।

গুরুতর এই সাইবার অপরাধ বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের সহকারী কমিশনার (এসি) নাজমুল হাসান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এ ধরনের এসএমএস শতভাগ ভুয়া এবং প্রতারণামূলক। প্রতারকরা বাংলাদেশি সিম ব্যবহার করে এ প্রতারণা চালাচ্ছে। আমরা তাদের ট্রেস আউট ও অবস্থান শনাক্ত করেছি।

তথ্য হাতিয়ে যে ধরনের প্রতারণা চালাচ্ছে চক্রটি :
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসএমএস পাঠিয়ে ফাঁদে ফেলে ই-মেইলের মাধ্যমে নাম, বয়স, ঠিকানা, ফোন নম্বর নিয়ে এ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। জনপ্রতি অর্থের অংকটা বেশি না হলেও ভুক্তভোগী অনেকে বলেন সব মিলিয়ে হাতানো অর্থের অংক বিপুল পরিমাণ।

রাহুল রায় নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ই-মেইলে তথ্য পাঠানোর পাঁচদিন পর তার কাছে একটি ফোন আসে। ফোনে ইংরেজি ভাষায় কথা বলে তাকে লটারির অর্থ জেতার বিষয়টি জানানো হয় এবং সেই অর্থগ্রহণের জন্য একটি বিকাশ নম্বরে ৪ হাজার ৮০০ টাকা (৬০ ডলার সমপরিমাণ) পাঠাতে বলা হয়।

রাহুল জানান, টাকা বিকাশ করে মোবাইল নম্বর ও ট্রানজেকশন রেফারেন্স নম্বর (TrxID) ই-মেইলে পাঠালেই কোটি টাকার চেক প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে জানায় প্রতারকরা।

আজাদ নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, মোবাইল করে লটারি জেতা অর্থগ্রহণের জন্য ১০০ ডলার দেওয়ার কথা বলা হয়। দরকষাকষির পর তারা ৫ ডলার অর্থাৎ ৪০০ টাকা বিকাশ করতে বলে। সেই টাকা পাঠানোর পর প্রতারকদের মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীকে মোবাইলে কল করে বাংলা ভাষায়ও লটারি জেতার কথা বলেছে চক্রটি। তাদের কখনো বাংলালিংক কখনো বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের নাম করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। বিদেশি এই চক্রটির সঙ্গে বাংলাদেশি কয়েকজনের যোগসাজশ রয়েছে। তবে পরিকল্পনাকারীরা সবাই বিদেশি বলে নিশ্চিত গোয়েন্দারা।

তাদের মতে, প্রতারকরা স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে মিলে বায়োমেট্রিক সিম ব্যবহার করে এ ধরনের অপকর্ম করছে।

গত ২৭ জুলাই এই প্রতিবেদককেও ০১৯৯৩-০৬৭১৮০ নম্বর থেকে ৫ লাখ পাউন্ড জেতার এসএমএস দেওয়া হয়। ফিরতি এসএমএসে লটারির বিস্তারিত ও অর্থগ্রহণের তথ্য জানার জন্য নাম-পরিচয় ও নম্বর দেওয়া হয়। পরে কোনো অগ্রগতি না থাকায় নম্বরটিতে ফোন দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর ই-মেইলে কয়েকটি তথ্য পাঠানো হলে ফিরতি ই-মেইল আসে কোকাকোলা বোটলিং কোম্পানি ইংল্যান্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম করে। সেখানে বেশ কিছু ‘তথ্য’র ফাঁদ পেতে ব্যক্তিগত তথ্য হাতানোর জাল ফেলা হয়। সেখানে বলা হয়, চেক প্রস্তুতের জন্য সাত কার্যদিবস লাগার কথা। তবে চেক হস্তান্তরের আগে ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল কিছু তথ্য চাওয়া হয়। যেমন- জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট নম্বর এবং সেগুলোর স্ক্যান করা কপি।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার আশঙ্কা :
প্রতারকদের তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ধরন সম্পর্কে বিশিষ্ট সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সাদ সরকার বলেন, সাইবার ক্রিমিনালরা সাধারণত এ ধরনের কাজই করে থাকে। কেউ যদি তাদের কথা বিশ্বাস করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো দেয়, তাহলে অপরাধীরা অনলাইন ব্যাংকিং বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হ্যাক (বেদখল) করে ফেলতে পারে।

তিনি বলেন, ফিরতি ই-মেইলে অনেক সময় অপরাধীরা বিভিন্ন লিংক দিয়ে ফাঁদ পেতে রাখে। লিংকে ক্লিক করলেই হ্যাকাররা কম্পিউটারে অ্যাকসেস নিয়ে ভুক্তভোগীকে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে।

পাঠকের মতামত: