ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

চকরিয়ায় আলীমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটের অবৈধদখলে সরকারি ৫০৬ একর খাস জমি থেকে রাজস্ব বঞ্চিত সরকার

dokholএম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :

চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নে আলীমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটের অবৈধ দখলে রয়েছে সরকারের ২৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫০৬ একর খাসজমি। বিগত ৬৪ বছর ধরে একটি প্রভাবশালী চক্র সরকারি এসব জমি নানা কায়দায় জবর দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০০৭ সালে ত্বত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উপজেলা প্রশাসন যৌথ বাহিনীর সহায়তায় এসব জমি উদ্ধার করে লাল পতাকা উচিয়ে দিলেও বর্তমানে বেদখলে থাকা এসব জমি উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসনের কোন ধরনের উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ করেছেন সচেতন মহল। অভিযোগ রয়েছে, বিপুল পরিমাণ এ জমি বেহাত হওয়ার কারনে প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তবে ভুমি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দখলে জড়িতরা উচ্চ আদালতে রীট মামলা দেয়ার কারনে রায় নিষ্পতি না হওয়ায় মুলত এসব খাস জমি উদ্ধারে গতি পাচ্ছেনা স্থানীয় প্রশাসন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার খুটাখালীর মেদাকচ্ছপিয়া মৌজায় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ি গ্রামের জাফর আলী চৌধুরীর ছেলে ইজ্জত আলী চৌধুরী’র নামীয় আর,এস ৫৬ খতিয়ানের ৮৬২ একর ৬৮ শতক জমি থেকে ১৯১৯ সালে আলিমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে ৩৩০৬ নং ভূঁয়া ওয়াক্ফ কবলা সৃজন করেন আলীমুদ্দীন চৌধুরী নামের একব্যক্তি। অথচ আর,এস খতিয়ানের রের্কডপত্রে তার কোন নাম নেই। ওই ভূঁয়া কবলা সৃজনের পর আর,এস, এম আর আর ও বি এস জরীপ সম্পন্ন হলে কোন জরীপে তাদের নামে ওই জমি রেকর্ড করতে পারেনি। ১৯২৮ সালে সম্পন্ন হওয়া আর এস জরীপের পর আর এস ৫৬ খতিয়ানের জমি থেকে ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাস্বত্ব আইনের ২০ ধারা মোতাবেক উল্লেখিত খতিয়ান থেকে ৩৭৫ বিঘার অতিরিক্ত জমি সরকারের কাছে হুকুম দখলের মাধ্যমে সারেুন্ডার করা হয়। পরে এ জমির ক্ষতিপূরণ বাবতে পুর্বের মালিক ফৌজুল করিম চৌধুরী (ক্ষতিপূরণ মামলা নং /৫৯-৬০ ইং মূলে) ওই সময় ১৭ হাজার ২৭৭ টাকা ৮০ পয়সা ও হাজী ফৌজুল কবির চৌধুরী (ক্ষতিপূরণ মামলা নং- ৩/৫৯-৬০ইং মূলে) ১৯ হাজার ৬৪০ টাকা ৩১ পয়সা সরকারের কাছ থেকে বুঝে নেন।

সুত্র জানায়, পরবর্তীতে এ জমি পিআরআর জরীপে পৃথক ৬টি খতিয়ানে বিভক্ত হয়েছে। তদমধ্যে ৫৬/১ ও ৫৬/২ খতিয়ানের ৪৩১ একর ৫৬ শতক ও ইজ্জত আলীর অধীনস্থ ১৫১ একর ৩৫ শতক জমি থেকে প্রায় ৫০৬ একর ২৬ শতক জমি সরকার খাসজমি হিসাবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভূক্ত করেন। ৫৬/৩ খতিয়ানে বর্তমান মোতায়াল্লি নজরুল ইসলাম চৌধুরী’র পিতা ফৌজুল করিম চৌধুরীর নামে ৫৭ একর ৮৯ শতক, ৫৬/৪ খতিয়ানে সুলতানুল কবির চৌধুরী, পিতা- ফৌজুল কবির চৌধুরীর নামে ৩২ একর ৭৭ শতক, ৫৬/৫ ও এমআরআর ৩৫ এবং বিএস ১৫৬ খতিয়ানে আবদুল জলিল মাস্টারের নামে ৫৯ একর ২০ শতক ও ৫৬/৬, এমআরআর ৩৮ ও বিএস ৭৬ খতিয়ানে হাজী গুরা মিয়ার নামে ১২৫, একর ১১ শতক জমি রেকর্ড করা হয়। বিএস জরীপে ১১৪ ও ১১৫নং বিএস খতিয়ানে মাত্র ১৪ একর ৮০শতক জমি আলীমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে রেকর্ড হয়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, মোতায়াল্লি বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও তার চাচাতো ভাই বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রয়াত নেতা সুলতানুল কবির চৌধুরীর পিতা এবং ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে সরকারী ভাবে ১০৫ একর ৪৬ শতক জমি রেকর্ডে উল্লেখ থাকলেও তারা বিগত ৬৪ বছর ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন্ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ও সরকারের বিরুদ্ধে কাল্পনিক মামলা করে সরকারী খাস খতিয়ানের ৫০৬ একর জমি ভূঁয়া ওয়াক্ফ এস্টেটের নাম ভাঙ্গিয়ে জরব দখলে রেখেছে। বর্তমানে ৫০৬ একর জমির (লবণ ও চিংড়ি জমি) বাজার মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, সরকারের বিপুল পরিমাণ খাসজমি প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় ১৯৯৫ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাদী হয়ে ৭৩ লাখ ৮০ হাজার ৫৬২ টাকা ও ২০০৭ সালে ১ কোটি ২৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন দখলবাজ চক্রের বিরুদ্ধে। তবে ওই সময় মোতাওয়াল্লি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও তার লোকজন এসব জমি দীর্ঘদিন ধরে ভোগ দখলে থাকার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ক্ষতি পূরণ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দুটি রিট পিটিশন মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলা গুলো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থার কারনে বেহাত হতে চলা সরকারের বিপুল খাসজমি উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসন কোন ধরণের গতি পাচ্ছেনা।

জানা গেছে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা প্রশাসন যৌথ বাহিনীর সহায়তায় (তৎকালীন সহকারী কমিশনার ভূমি সাইফুল ইসলামের) নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে মেদাকচ্ছপিয়াস্থ আলীমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটের অবৈধ দখলে থাকা সরকারের ৫০৬ একর খাস জমি উদ্ধার করেন। এ সময় প্রশাসন ওই জমিতে লাল পতাকাও উচিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মোতাওয়াল্লি নজরুল ইসলাম চৌধুরী নানা কায়দায় প্রশাসনের দেয়া লাল পতাকা উপড়ে ফেলে ফের এসব জমি আবারও জবর দখল করে নেয়। সেই থেকে এখনো দখল রয়েছে এসব জমি।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রায় ৬৪ বছর ধরে ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে প্রভাবশালীরা সরকারের বিপুল পরিমাণ খাস জমি এভাবে অবৈধ দখলে রাখলেও ইতিপূর্বে স্থানীয় প্রশাসন এসব জমি উদ্ধারে কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো প্রশাসনের কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে গোপনে দখলবাজদেরকে নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এ সুযোগে ওয়াক্ফ এস্টেটের সংশ্লিষ্টরা বছরের পর বছর এসব জমি দখলে রেখে চলছে। এভাবে তারা বিগত ৬৪ বছর ধরে এসব জমি দখলে রেখে লবণ ও চিংড়ি চাষাবাদ করে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অপরদিকে বিপুল পরিমাণ খাসজমি বেদখলে থাকায় সরকারও প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

স্থানীয় সচেতন মহল সরকারের বিপুল পরিমাণ এসব খাস জমি অবৈধ দখলমুক্ত করতে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

 

পাঠকের মতামত: