ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

চকরিয়া বদরখালী সমিতির তিন কর্মচারীর অনিয়ম দূর্নীতি ধামাচাপা দিতে দৌড়ঝাঁপ

oniyom durnitiএম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :::

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী সমবায় ও কৃষি উপনেবিশ সমিতিতে ২২বছর আগে মাষ্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত হিসাব রক্ষক শাহ আলম এতদিনের ব্যবধানে কয়েক কোটি টাকার দোকান-পাট ও বহুতল ভবনের মালিক হয়েছেন বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অল্প বেতনে চাকুরী করে তিনি সমিতির সামনে বাজারের ভেতর নামে-বেনামে অন্তত ২৪টি দোকানের মালিক কিভাবে হয়েছেন তা স্থানীয় জনগন ও সমিতির সকল স্থরের সভ্যদের ভাবিয়ে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে, এত সব সম্পদের মালিক হওয়ার পরও শাহ আলম চাকুরী করে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন সমিতিতে। জড়িয়ে পড়েছেন অনিয়ম ও দুর্নীতির মহোৎসবে।

অভিযোগে জানা গেছে, সমিতির হিসাব রক্ষক শাহ আলম ২২বছর ধরে সমিতিতে মাষ্টাররোলে কর্মরত রয়েছেন। সমিতির সকল হিসেব-নিকাশের যাবতীয় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার নেপথ্য নায়ক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে আসছেন। সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটিতে থাকা সভাপতি, সম্পাদক সহ দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তারা শাহ আলমকে ব্যবহার করে নিজেরা অনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে বছরের পর বছর । যার কারণে শাহ আলমকে দালিলিক বহু প্রমাণ পাওয়া সত্বেও কোন তদন্তে তাকে দোষী করা যাচ্ছে না। তদন্ত কমিটি ও অডিট কমিটিকে ম্যানেজ করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যেমন পার পেতে সহায়তা করছে ঠিক তেমনি নিজের সীমাহীন দুর্নীতিকেও কৌশলে ঢাকা দিচ্ছে এ হিসাব রক্ষক। সমবায় সমিতি আইনের ৪৯ ধারা ও একই আইনের ৮৩ ধারার তদন্তে হিসাব রক্ষক শাহ আলমকে প্রায় ৩ লক্ষ সাড়ে বাইশ হাজার টাকার জন্য দায়ী করেন। একই অপরাধে তার ভাই সমিতির কোষাধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিনকে চাকুরীচ্যুত করা হলেও হিসাব রক্ষক শাহ আলমকে উল্টো প্রমোশন দেন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির লোকজন। ওইসময় আত্মসাতকৃত টাকা ফেরৎ না দিয়ে বরং উক্ত শাহ আলম সমিতির বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রীট মামলা দায়ের করেন। হিসাব রক্ষক শাহ আলমের এমন দু:সাহসে কিংকর্তব্য বিমুঢ় সমিতির প্রবীন সদস্য মাষ্টার জলিল ও আমিন শরীফ।

অভিযোগ মাত্র ৫ হাজার টাকার বেতনের কর্মচারী শাহ আলম ১৯৯৪ সনে সমিতির হিসাব রক্ষকের পদে যোগদান করে কতো টাকা ও সম্পদের মালিক হতে পারে? সমিতির প্রয়াত ম্যানেজার এমদাদুল হকের মৃত্যুতে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি শাহ আলমকে হিসাব রক্ষণ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ না থাকা সত্বেও সমিতিতে হিসাব রক্ষকের চাকুরি দেন। যে ক্ষেত্রে বদরখালী সমিতির ২৬২ শেয়ারের মধ্যে অদ্যাবধি ৬০-৬৫ শেয়ার ১টি দোকান ভিটার মালিক হতে পারেনি। সেক্ষেত্রে ২২ বছরের ব্যবধানে নানা উপায়ে শাহ আলম বদরখালী বাজারের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ২৪টি দোকান, বদরখালীর বাহিরে ও অন্য এলাকায় ১০-১১ একর জমির মালিক হয়েছেন। এসব সম্পদের বাজার মুল্য ৩ কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছেন একাধিক সুত্র। অভিযোগ আছে, এক কর্মকর্তার সাথে সমিতির চিংড়ি প্রকল্পের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার মতো। নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল টাকা রয়েছে তার।

জানা গেছে, সমিতির উপ-আইনের সুস্পষ্ট বিধান “হিসাব রক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি কোষাধ্যক্ষ তথা নগদ অর্থ রাখার দায়িত্ব পালন করিবে না” অথচ হিসাব রক্ষক শাহ আলম সমিতির চিংড়ি প্রকল্প ইজারার ও বিভিন্ন খাতের আয়লব্ধ টাকা মাসের পর মাস নিজের পকেটে রেখে এবং তা বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করে নিজে এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অনৈতিকভাবে লাভবান করছে বছরের পর বছর। গত এক দশক ধরে সমিতির প্রায় সাধারণ সভায় দুর্নীতিবাজ কর্মচারী শাহ আলমসহ অন্যদের চাকুরীচ্যুত করার দাবী সাধারণ সদস্যরা জানালেও তা সমিতির কর্মকর্তারা আমলে নেয়নি কোনদিন। সমিতির একাধিক প্রবীণ সভ্য দাবি করেন, স্বচ্ছলতা ও জবাবদিহিতা সোপানে বর্তমান সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হলেও তারা অধ্যবদি শাহ আলমের ব্যাপারে কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং তারা সমিতির শাহ আলমকে একমাত্র সমিতি প্রেমিক (!) হিসাবে আখ্যায়িত করেন। অভিযোগ উঠেছে, সমিতির বিদায়ী কমিটির সভাপতি নূরুল আলম সিকদার তার কোটি টাকার ব্যবসার অংশীদার হিসাবে হিসাব রক্ষক শাহ আলমের কোন দোষ আমলে নেন না একেবারে।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, হিসাবরক্ষক শাহ আলমের মতো একইভাবে সমিতিতে বিধি বর্হিভুতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারি ব্যবস্থাপক ও ক্যাশিয়ার নুরুল আমিনের অবৈধ আয় ও সম্পদের পরিমাণ নিয়ে সমিতির সভ্য পোষ্যদের মাঝে নানা ধরণের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

গত ছয়মাস ধরে সমিতিতে নির্বাচিত কমিটি না থাকার সুযোগে সমিতির নানা খাতে খরচের ভুঁয়া ভাউচার তৈরী করে লাখ লাখ টাকা হরিলুটে নেমেছে বলে দাবি করেছেন সমিতির সভ্যরা। তাদের এই অপতৎপরতার কারনে বর্তমানে সমিতির সভ্য, পোষ্যসহ প্রায় ৪০হাজার জনগোষ্টির ভাগ্য অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। অভিযুক্ত তিন কর্মচারী সমবায় আইন, বিধিমালা ও সমিতির উপ-আইন লংঘন করে এসব অনিয়ম করছেন বলে দাবি সমিতির সচেতন সদস্যদের।

সমিতির অনেক সদস্য অভিযোগ করেছেন, হিসাবরক্ষক শাহআলম, সহকারি ব্যবস্থাপক নাছির উদ্দিন ও ক্যাশিয়ার নুরুল আমিন দীর্ঘদিন ধরে সমিতিতে চাকুরী করার সুবাদে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অনেকটা পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। নতুন কমিটি আসলেই তাঁরা বিভিন্ন চলচাতুরীর মাধ্যমে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে নিজেদের অনিয়ম ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা প্রতিবছর বার্ষিক সাধারণ সভায় অনুমোদন যোগ্য বিভিন্ন খাতে অব্যয়িত প্রায় ৫০-৬০লাখ টাকা (তখনকার দায়িত্ব পালনকারী কমিটির কয়েকজনের ) যোগসাজসে ভুঁয়া বিল ভাউচার তৈরী করে খরচের মাধ্যমে এসব টাকা আত্মসাত করে আসছেন। তদন্ত করলে অতীতের অনেক অনিয়ম ধরা পড়বে বলে দাবি করেন সমিতির সদস্যরা। অভিযোগ রয়েছে, ওইসময় সমিতির কেউ এব্যাপারে প্রতিবাদ ও তাদের চুরি ধরিয়ে দিলে পরে তাকেও কিছু দিয়ে ম্যানেজ করেন এ তিন কর্মচারী। ফলে অনিয়মের এ ধরণের বড় ঘটনা আর জনসম্মুখে প্রকাশ পায় না।

সমিতির ক্ষুদ্ধ সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, ক্যাশিয়ার নুরুল আমিন সমিতির টাকা মাসের পর মাস তার নিজের মতো নিজের কাছে রেখে দেয়। ওইসময় তিনি সমিতির টাকা ব্যবহার করে খন্ডকালীন ব্যবসাও করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। এভাবে তিনি সমিতির টাকা ব্যবহার করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে স্থানীয় সুত্রে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও তিনি সমিতির আয় খাতের টাকার রশিদ ও ব্যয়খাতে ভাউচার জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেন বলে সমিতির একাধিক সদস্য দাবি তুলেছেন। অপরদিকে সহকারি ব্যবস্থাপক নাছির উদ্দিন সমিতিকে নিজের দলিল লিখার অফিসে পরিণত করেছে দীর্ঘদিন ধরে। সমিতির কম্পিউটার, কালি ও কাগজ ব্যবহার করে তিনি প্রতিমাসে ৫০হাজার টাকার বেশি অবৈধ আয় করছেন। এতে সমিতি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও লাভবান হচ্ছে নাছির উদ্দিন। এছাড়াও তিনি দায়িত্ব পালনকালীন কমিটির অজান্তে জায়গা-জমির ভুঁয়া রেজুলেশন, সমিতির সম্পদের রেজুলেশন, সমিতির মালিকানাধীন দোকানের রেজুলেশন তৈরী করে মাসিক মিটিংয়ে গোপনে ঢুকিয়ে দিয়ে কৌশলে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

সমিতির একাধিক সদস্য দাবি করেছেন, সমিতির এই তিন কর্মচারী নানা কায়দায় সমিতির মালিকানাধীন চিংড়ি প্রকল্প ইজারা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতে সংশ্লিষ্টদের যোগসাজসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাঁরা বর্তমানে সমিতির দেড়হাজার সভ্য, পোষ্যসহ প্রায় ৪০হাজার জনগোষ্টির ভাগ্য ও সম্পদ নিয়ে লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছে।

সমিতির সদস্যরা অভিযোগ তুলেছেন, দুর্নীতিবাজ তিন কর্মচারীকে সমিতির স্ব স্ব পদ থেকে অপসারণ করা না হলে অল্প সময়ের ব্যবধানে বদরখালী সমিতি একটি দেউলিয়া প্রতিষ্টানে রূপ নেবে। তাই ৪০হাজার মানুষের ভাগ্য ও সমিতির সম্পদ রক্ষার স্বার্থে অভিযুক্ত তিন কর্মচারীর অবৈধ সম্পদ উদ্ধারপুর্বক তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সমিতির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এদিকে সমিতির অভিযুক্ত তিন কর্মচারী তাদের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তাঁরা ইতোমধ্যে গণমাধ্যমের কাছে লিখিতভাবে দাবি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে সমিতির কতিপয় সদস্যদের করা সব অভিযোগ অবান্তর ও কাল্পনিক। সমিতির নির্বাচিত বা এডহক কমিটির সংশ্লিষ্টদের নির্দেশে দায়িত্ব পালন করেন মাত্র। কতিপয় মহল তাদের নামে এসব মিথ্যাচার করছে বলেও দাবি করেন তাঁরা।

বিষয়টি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো.বখতিয়ার কামাল বুধবার বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, অভিযুক্ত তিন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকতে পারে এটা অসত্য নয়। কিন্তু এব্যাপারে কেউ লিখিত অভিযোগ না করলে আমরা কিভাবে ব্যবস্থা নেব তাদের বিরুদ্ধে। প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বীকার করেন, আগেও একবার সমিতির হিসাবরক্ষক শাহআলমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম সমবায় বিভাগের কর্মকর্তারা দুর্নীতির তদন্ত করেছেন। পরে কিন্তু ওই তদন্ত কি হয়েছে তা আমার জানা নেই। #

পাঠকের মতামত: