ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস দালালদের দখলে

কক্সবাজার জেলা পাসপোর্ট অফিসে থেমে নেই দালাল চক্রের প্রতারণা। সাধারণ মানুষদের হয়রানী ও জিম্মি করে টাকা আদায়ের মহোৎসব চলছে। আর এতে সরাসরি সহযোগিতা করছে পার্সপোট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। পুরাতন পার্সপোট দালালদের সাথে নতুন নতুন দালাল ও মৌসুমী দালালদের আবির্ভাব ঘটেছে। এতে সাধারণ পাসপোর্ট করতে আসা মানুষের ত্রাহি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে কক্সবাজারে জেলার পাসপোর্ট অফিস নতুন ভবনে স্থানান্তর হয়। এ অফিসে কার্যক্রম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন-নতুন দালাল গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে পড়েছে। দালাল-কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মিথ্যে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নারী, বৃদ্ধ ও গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের নানাভাবে হয়রানীর শিকার করছে এই দালাল চক্র। সরকারী বিবরণী মতে, বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক সরকারী নির্ধারিত ফিঃ ব্যাংক ড্রাপ করে জাতীয় পরিচয় পত্র/জন্ম সনদ, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, ২ কপি পার্সপোট সাইজের ছবি সহ নিদিষ্ট ফরম পূরণ করে পার্সপোট অফিসে জমা দিয়ে পার্সপোটের জন্য আবেদন করতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাসপোর্ট অফিসের চরম অসহযোগিতা এবং দালালচক্রের সক্রিয় অবস্থানের কারণে পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মচারীরা অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ফরম জমা নেয় না। নানা রকম সমস্যা এবং সময়ক্ষেপন করে সাধারণ মানুষদের চরম ভাবে মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দেয় পাসপোর্ট কর্মকর্তারা। কারণে-অকারণে এবং অযৌক্তিকভাবে সেসব আবেদনপত্রে লাল কালির চিহ্ন দিয়ে আবেদনপত্রগুলো বাতিলও করে দেন। খোদ পার্সপোট অফিস থেকেই দালালদের দেখিয়ে দেওয়া হয় । দালালদের কাছে গেলে পাসপোর্ট অফিসের বাবুদের লাল কালির কাঁটা ছেড়ার উপর টাকা কমবেশি বাড়ে বলে জানা যায়। পাসপোর্টের দালালরা ওই একই কাঁটা-ছেড়া ফরম জমা দিয়ে ছবি ও ফিঙ্গার নিয়ে নেন। এ যেন আলাউদ্দিনের আশ্চর্য চেরাগ। দলাল’রা একটু ঘষা দিলেই সব সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। সত্যায়িত করার সীল, জন্মনিবন্ধন ফরম, চেয়ারম্যান সনদসহ যাবতীয় জাল কাগজপত্রের সবকিছুই রয়েছে দালালদের হাতে। প্রয়োজন শুধু টাকার। দালালরা সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে লাঞ্চিত করতেও দ্বিধা করে না এই দালাল চক্র। এই দালাল চক্র পার্সপোট অফিসের বিশ্বস্থ সহচর। সূত্রে জানা যায়, সরকারী হিসাবে সাধারণ পাসপোর্টের জন্য শুধু মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকা এবং ইমারজেন্সি পাসপোর্টের জন্য ৮ হাজার টাকা ব্যাংক ড্রাপের মাধ্যমে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার কথা থাকলেও এই দালাল’রা সাধারণ পাসপোর্টের জন্য ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা এবং ইমারজেন্সী পাসপোর্টের জন্য ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা আদায় করে। আর প্রতিটি সাধারণ পাসপোর্টের জন্য ১২শ এবং ইমারজেন্সী পাসপোর্টের জন্য ২ হাজার থেকে ২২ শ টাকা পর্যন্ত দালালদের মাধ্যমে পায় পাসপোর্ট অফিসের কর্তাব্যক্তিরা। ফরমের উপর সংকেতিক চিহ্ন দিয়ে দালালের নাম ও টাকার অংকের পরিমাণ দেখানো হয়। সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে এত টাকা নেওয়ার পরও অনেক সময় দালালদের পেট ভরে না। পাসপোর্টে বিভিন্ন সমস্যা, জটিলতা ও টেক্যনিক্যাল বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সুযোগ বুঝে মোটা অংকের টাকাও হাতিয়ে নেন এ দালাল চক্র। অনেক সাধারণ মানুষ মনে করেন পার্সপোর্টের দালালী এ কেমন পেশা? মানুষদের জিন্মি করার মাধ্যমকে যারা পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে তারা সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষদের একাংশ বলে মনে করেন সাধারণ ভূক্তভোগিরা। দালালচক্রের রয়েছে সমিতি, শহরের বহুতল ভবনে বিলাসবহুল অফিস। তাদের এই সৌখিনতা আর আরাম-আয়েশের চাহিদাও মিটাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, পার্সপোট অফিসের চিহিৃত বেশিরভাগ দালালদের অবস্থান এবং অফিস শহরের লালদিঘীর পাড়স্থ বিভিন্ন মার্কেটে। শহরের জিয়া কমপ্লেক্স, আরমান বোর্ডিং, এ.বি সুপার মার্কেট, পাঁচতারা হোটেল, হোটেল মৌসুমী, ইডেনগার্ডেন সিটি এবং কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ মার্কেটসহ অন্যান্য অনেক ব্যায়বহুল মার্কেটে দোকান/অফিস ভাড়া নিয়ে এ সমস্ত প্রতারণা করে যাচ্ছে এই দালাল চক্র। পাসপোর্ট আবেদন ফরম লিখক নামক তাদের রয়েছে একটি সংগঠন। সূত্রে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিস থেকেই প্রতি মাসে ১.৫ লক্ষ টাকা করে চাঁদা আসে এই সংগঠনের নামে। পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে প্রতি সপ্তাহে বসে গোপন বৈঠক। সন্ধ্যার পর থেকে এসব অসাধু কর্মচারীদের দেখা যায় লালদিঘীর পাড়ের বিভিন্ন দালালদের দোকান কিংবা অফিসে। মূলত দালালরাই নিয়ন্ত্রণ করে এই সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে দিয়ে জোর করে কাজ করে নেওয়ারও অনেক অভিযোগ রয়েছে এই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে। এ চক্রের প্রধান হোতা হিসাবে সদর ঈদগাঁহ এলাকার জানে আলম, মহেশখালীর আজিজ, হাসেম, সাইফুল, সোলাইমান, লিংকরোডের নাছির উদ্দিন, চকরিয়ার মৌলভী সোলেয়মান, রাজু, সাইফুল, রিদুয়ান, চৌফলন্ডীর আমিন, পিএমখালীর সানা উল্লাহ, রামু পানিরছড়া এলাকার শাহিন, মিঠাছড়ি এলাকার আমিন, আমান উল্লাহ, গর্জনিয়ার শাহাব উদ্দিনসহ শহিদ, জাহাঙ্গীর আলম, নাজিম উদ্দীন, আবছার উদ্দীন, রনতোষ দে, ফরিদুল আলম, আব্দুল খালেক, হেফাজতুর রহমান আরও ২৫/৩০ জনের সক্রিয় দালাল রয়েছে এ চক্রের। গতকাল ২৭ (জুলাই) এ চক্রের একজন সদস্য দাম্বিকতার সাথে বলেন আমাদের সমিতিতে ১ কোটি টাকার উপর জমা আছে। আমরা যা খুশি তা করতে পারি, আমরা যা করছি প্রকাশ্যে করছি আমাদের কেউ কিছু করতে পারবে না। এ চক্রের অনেকেই একসময় স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের রাজনীতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে সূত্রে জানা যায়। বর্তমানে তারা ভোজ পাল্টিয়ে স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামীলীগের রাজনীতির গাঁ ঘেষার চেষ্টার করছেন বলে জানা যায়। আওয়ামীলীগের বিভিন্ন প্রগাঢ় রাজনৈতিক নেতারা এমনকি কি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত এ সমস্ত মৌসুমি ব্যক্তিদের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখার আদেশ নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া এই দালালদের অনেকেই জঙ্গীদের পার্সপোট পেতে সহায়তা ও মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সাথে যোগাযোগ থাকতে পারে বলেও সূত্রে জানা যায়। স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে ম্যানেজ করে এবং গুটিকয়েক সাংবাদিকদের মাসিক মাসোহারা দেওয়ার জন্য ১ জন কথিত সাংবাদিকের মাধ্যমে এই টাকা বন্টন করে বলে সূত্রে জানা যায়। দিন দিন মানুষ এই দালাল চক্র দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে, দালালরা লাভবান হচ্ছে। আর অন্যদিকে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গ্রামঞ্চল থেকে আসা সাধারণ মানুষ। দালালচক্রের খপ্পরে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন স্থনীয়মহল। এদিকে, গতকাল (২৭জুলাই) সরেজমিনে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অফিসের অভ্যন্তরে কাজ চলছে ঢিলেঢালা ভাবে। দুপুর ১২টা পর্যন্তও এনরোলমেন্ট রুমে কাজ করার কোন কর্মকর্তা কর্মচারী দেখা যায়নি। রুমের বাইরে দীর্ঘ লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা সাধারণ মানুষদের অহেতুক দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ফিঙ্গার আর ছবি দিতে আসা এই সব মানুষগুলোর সময়ের যেন কোন দাম নেই, তাদের যেন কোন কষ্ট নেই। লাইনে দাঁড়ানো অনেক মানুষ ক্ষোভ ও কষ্ট প্রকাশ করে এ প্রতিবেদককে বলেছেন, সকাল থেকে লাইনে দাড় করিয়ে রেখেছে কিন্তু ফিঙ্গার বা ছবি নেওয়ার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। কিছু বললেই আনসার সদস্যরা মারার জন্য তেড়ে আসে অত্যন্ত দুব্যবহার করে। এ প্রতিবেদক তাৎক্ষনিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ছবি তুললে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আবু নাঈম মাসুম ছবি তুলতে নিষেধ করেন। কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী আবু নাঈম মাসুম জানান আমার হাতে পুলিশী কোন ক্ষমতা নাই যেখানে আমি দাওয়া করে দালালদের ধরে ব্যবস্থা গ্রহণ করব এবং তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, আপনি বলেন আমি কি দালালদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে আসবো? তবে তিনি সাধারণ মানুষদের ভোগান্তির কথা স্বীকার করেছেন এবং দালালদের মাধ্যমে ফরম পূরণ করার কথাও তিনি অস্বীকার করতে পারেনি। তবে, তার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে যাতে কোন অনিয়ম না হয় সেজন্য তিনি সিসিটিভি ক্যামরা বসিয়ে সকলকে নজদারীতে রেখেছেন বলে জানান । পাসপোর্ট প্রত্যাশী গ্রাহকদের সাথে তিনি প্রতিদিনিই কথা বলেন এবং দালালদের খপ্পরে না পরার জন্য নির্দ্দেশনাও দেন। তারপরও যদি কেউ বিপদগামী হয়ে দালালদের খপ্পরে পড়েন এতে তার কোন কিছু করার নাই। জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস দূর্নীতি মুক্ত করতে তিনি আপ্রণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান। তা স্বত্বেও দালালদের দৌরত্ব্য থেমে নেই। থেমে নেই তাদের অপতৎপরতা। পাসপোর্ট অফিসের স্টাফদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে দালাল চক্র পুরা জেলাব্যাপী নের্টওয়ার্ক বসিয়ে তাদের বিস্তৃন কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস একেবারেই উদাসীন বা জেনেও না জানার ভান করে আছে বলে সচেতন মহল মনে করছে।

পাঠকের মতামত: