ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

জেলে থাকতে হলেও দ্রুত দেশে ফিরতে চাই : সালাহউদ্দিন

১৬ জুলাই। বিকেল চারটা। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পাহাড়ঘেরা শিলং শহরের নানা গলি-উপগলি পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই ‘সানরাইজ রেস্টহাউসে’। তিনতলা ওই হাউসে প্রায় স্থায়ীভাবে বাস করেন একজন ‘বিদেশি অতিথি’।
অভ্যর্থনাকক্ষে নাম লিখে ভেতরে ঢুকতেই দেখি নিচতলার ছোট্ট বৈঠকখানায় সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরিহিত ‘অতিথি’ গল্প করছেন কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। তাঁরা গণমাধ্যমকর্মী—কেউ ভারতের, কেউ বাংলাদেশের। চোখে চোখ পড়তেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’
এই অতিথির নাম সালাহউদ্দিন আহমদ, বিএনপির অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব। ১৬ মাস আগে তিনি কীভাবে এখানে এসেছেন বা নীত হয়েছেন, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়, সেটি এখন শিলং চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারাধীন।
গত বছরের শুরুতে বিএনপির অবরোধ চলছিল বাংলাদেশে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তাঁর অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখে। মহাসচিবসহ দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা জেলে বা আত্মগোপনে। এই কঠিন অবস্থায় ‘অজ্ঞাত’ স্থান থেকে প্রায় প্রতি রাতে যাঁর কণ্ঠ শোনা যেত বা বিবৃতি পাওয়া যেত, তিনি সালাহউদ্দিন আহমদ। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ। সরকারি দলের নেতারা বলতেন, ‘তোড়াবোড়া পাহাড়’ থেকে এসব ঘোষণা আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হন্যে হয়ে খুঁজেও ‘ঘোষককে’ পাচ্ছে না।
একদিন হঠাৎ সেই ‘অজ্ঞাত’ স্থান থেকে ঘোষণা আসা বন্ধ হয়ে গেল। বিএনপির নেতারা অভিযোগ করলেন, উত্তরার এক বাসা থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলল, তারা কিছু জানে না।
বেশ কিছুদিন পর খবর এল, শিলংয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে দেখে স্থানীয় লোকজন তাঁকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। এরপর চিকিৎসার জন্য মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে ফরেনার্স আইনে মামলা হলো। আদালত তাঁকে জামিন দিলেও বলে দিয়েছেন, তাঁদের অনুমতি ছাড়া শিলংয়ের বাইরে যাওয়া যাবে না।
আশির দশকের শুরুতে ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করে সালাহউদ্দিন আহমদ নিজেই রাজনীতি নিয়ে কথা শুরু করলেন। বললেন, বাংলাদেশের রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি কলুষিত করেছেন এরশাদ। বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে নেওয়া থেকে ছাত্র মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দেওয়ার নজিরও স্থাপন করেছেন এই সেনাশাসক। আগে সরকারবিরোধী মিছিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ত ও লাঠিপেটা করত। এরশাদের আমলেই মিছিলে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়।
ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তখন ভদ্র ও মেধাবীরা ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আসতেন। সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত কেউ নেতা হতে পারতেন না। হেমায়েত হোসেন আওরঙ্গ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অনেক প্রভাবশালী হয়েও ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে যেতে পারেননি। ছাত্রদলেও নিরু-শহীদ নেতা হতে পারেননি।
জিজ্ঞেস করি, তাঁর বিরুদ্ধে ফরেনার্স আইনে যে মামলা হয়েছে, তার পরিণতি কী? তিনি বললেন, ‘কী ঘটনা ঘটেছে, সবাই জানেন। এখানকার বিচারব্যবস্থার ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সাক্ষ্য নেওয়া শেষ। ২৭ আগস্ট মামলার পরবর্তী শুনানি।’ তিনি আরও বলেন, মামলার রায়ের পরই তিনি দেশে ফিরে যাবেন, এমনকি যদি তাঁকে দেশে গিয়ে জেলেও থাকতে হয়।
কিছুদিন আগে সালাহউদ্দিন দিল্লিতে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। আবারও যাবেন কি না, উত্তরে বললেন, তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রে তিনটি ব্লক আগেই ছিল। এখানে আসার পর কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই হয়তো আবার যেতে হবে।
জিজ্ঞেস করি, রেস্টহাউসের বাইরে বের হন কি না। বললেন, শহরে বের হতে কোনো বাধা নেই। বিকেলে তিনি হাঁটতে বের হন। ওই দিন দুপুরে জুমার নামাজ পড়েছেন মদিনা মসজিদে। নদী উৎসবে যোগ দিতে আসা কয়েকজন সাংবাদিক তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি তাঁদের প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন। তবে টিভিতে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ দেননি কাউকে। দু-একজন সাংবাদিক বন্ধু জোর করলে কিছুটা বিমর্ষ কণ্ঠে এই ‘নির্বাসিত’ বিএনপি নেতা বলেন, ‘আপনারা আমাকে আবার জেলে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন না।’
বিএনপির রাজনীতিতে শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থাভাজন সালাহউদ্দিনের দিন কাটে অভ্যাগতদের সঙ্গে গল্প করে, গান শুনে, বই পড়ে। দেশে আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তাঁর নিয়মিত কথা হয়। স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যসহ কয়েকজন দলীয় নেতা তাঁর সঙ্গে দেখাও করে গেছেন। মাঝেমধ্যে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আসেন। এখানে তাঁরা একসঙ্গে ঈদ করেছেন। কিছুটা স্বগতোক্তি করে তিনি বললেন, ‘আমার পরিবার তো এখন “আন্তর্জাতিক” হয়ে গেছে। ছেলে থাকে কানাডায়। স্ত্রী ও মেয়ে ঢাকায়। আর আমি এখানে।’
কথা বলতে বলতেই ঢাকা থেকে একজন টেলিফোন করে গুলশানে জঙ্গি হামলার পর দলের অবস্থান নিয়ে প্রথম আলোর একটি রিপোর্ট লিংক করার কথা বললেন। রিপোর্টটি পড়েছেন জানিয়ে সালাহউদ্দিন তাঁর কাছে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলছেন! নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াত নিবন্ধিত দল নয়, তারা নির্বাচনও করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধকরণের মামলাটি কেন এত দিন ঝুলে আছে? সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু তারা তা করছে না কেন?’ তিনি আরও যোগ করলেন, ২০০১ সালের পর দেশের রাজনীতিতে যা হচ্ছে, সবই ভোটের হিসাব সামনে রেখে। আওয়ামী লীগ দেখেছে, বিএনপি-জামায়াত এক থাকলে তারা পারবে না। এ কারণেই বিএনপি থেকে জামায়াতকে দূরে রাখতে চায়।
তাঁর কথা শুনে মনে হলো, দলের ভেতরে যতই চাপ থাকুক, বিএনপি জামায়াতকে ছাড়বে না। লন্ডনে হাউস অব কমন্সে দুই দলের সংলাপেও বিএনপি নেতারা বলেছেন, ‘জামায়াত যদি সন্ত্রাসী সংগঠনই হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগ তাকে নিষিদ্ধ করুক।’
দলের সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির এই নেতা বলেন, চেয়ারপারসন দল পরিচালনা করলেও নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা যদি সেটি না করেন, তিনি (চেয়ারপারসন) কী করতে পারেন? তাঁর দাবি, দলের কাউন্সিল হলেও কমিটি তিনি যে অবস্থায় রেখে এসেছেন, সেখানেই আছে।
আলোচনায় আসে গুলশানে জঙ্গি হামলার বিষয়ও। অন্যান্য বিএনপি নেতার মতো সালাহউদ্দিনও মনে করেন, গণতন্ত্রহীনতার কারণে এসব হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি আমলে সংঘটিত জঙ্গি হামলার কারণও কি গণতন্ত্রহীনতা? সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি।
কবে নাগাদ দেশে যাবেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘মামলার রায় যা-ই হোক না কেন, দ্রুতই দেশে যেতে চাই। এখানে রাজনীতি নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। দেশেই দেখা হবে, কথা হবে।’ তবে শিলংয়ের এক সাংবাদিক বন্ধু জানান, মামলাটি দ্রুত শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। আদালত সালাহউদ্দিনকে শাস্তি দিলে তিনি আপিল করবেন, আর ছাড়া পেলে সরকার আপিল করবে। সেই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেননি বিএনপি নেতাও।
ওই দিন সন্ধ্যায় কথা হয় মামলায় সরকারপক্ষের আইনজীবী এ সি ঝাওয়ের সঙ্গে। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, যদি সালাহউদ্দিন প্রমাণ করতে পারেন, তিনি স্বেচ্ছায় আসেননি, আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাহলে কি শাস্তি এড়াতে পারেন? জবাবে এই আইনজীবী বললেন, আইনে কীভাবে এসেছেন সেটি বিবেচনার সুযোগ নেই। তাঁর কাছে বৈধ কাগজপত্র নেই, এটাই বিবেচ্য বিষয়। প্রথমআলো

পাঠকের মতামত: