ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

পেকুয়ায় খোলা আকাশের নিচে দুই হাজার পরিবার ।। বেড়িবাঁধ বিলীন, জোয়ার-ভাটায় দুর্ভোগ

ছোটন কান্তি নাথ ও মো. ছফওয়ানুল করিম ।।

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডবে সমুদ্র তীরবর্তী কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার চার ইউনিয়ন মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও পেকুয়া সদরের অন্তত ২ হাজার পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু বসতিহীন ভিটের দেখা মিলবে। মাত্র কয়েকঘণ্টার তাণ্ডবে মাথা গোঁজার ঠাই বসতবাড়ি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে এসব পরিবার। এ অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলো একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়ায় সামুদ্রিক জোয়ারভাটা অব্যাহত রয়েছে এসব ইউনিয়নে।এতে একদিকে বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব, অন্যদিকে জোয়ারের পানিতে দুর্ভোগ আরো চরমে পৌঁছেছে।

সরেজমিন পেকুয়া উপজেলার মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও পেকুয়া সদর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, এ চার ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রামের মানুষ দুর্বিষহ অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বসতবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে খাঁ খাঁ করছে ভিটে। এপাড়া থেকে ওপাড়া যেদিকেই চোখ যায় শুধু দেখা মিলবে ক্ষতচিহ্ন ও দুর্ভোগের চিত্র। এ অবস্থায় শিশুসহ পরিবার সদস্যদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। রোয়ানুর তাণ্ডবে বসতবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হওয়া মগনামা ইউনিয়নের শরৎঘোনা গ্রামের আবদুল মালেকের পুত্র কাইছার উদ্দিন বলেন, ‘সেদিন (২১ মে) সকাল ৯টার দিকে বাতাস শুরু হলে বাড়ি তালাবদ্ধ করে পরিবারের সদস্যসহ পার্শ্ববর্তী সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নিই। কিন্তু কয়েকঘণ্টা পর এসে দেখি পুরো বাড়িটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, বাড়ির চালা পর্যন্ত উপড়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার পরিবারে দুই শিশুসহ ৮ সদস্য রয়েছে। কিন্তু ভিটের ওপর বাড়ি না থাকায় মাথা গোঁজারও ঠাঁই হচ্ছে না। তার ওপর বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যাওয়ায় সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে দুর্ভোগ আরো চরমে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় ৫দিন ধরে এখানেওখানে রাত কাটাচ্ছি, চুলোয় আগুন না জ্বলায় হাঁড়িও চড়েনি এতদিন। শুকনো খাবার খেয়েই দিন পার করছি।’ একই কথা জানালেন বসতবাড়ি হারানো পাশের বাসিন্দা মৃত অজি উদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার, পশ্চিম বাড়ার পাড়ার এবাদুল্লাহর পুত্র আবু তাহেরসহ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।রাজাখালী ইউনিয়নের বকশীঘোনা গ্রামের নুরুল আলমের পুত্র আজাহার উদ্দিন, বাদশা মিয়ার পুত্র মো. ইউনুছ ও মহিউদ্দিন, মো. শরীফের পুত্র মোস্তাক আহমদ ও ছৈয়দ নূর বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে বসতবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় গত পাঁচদিন ধরে খোলা আকাশের নিচে পলিথিন দিয়ে ঝুপড়ি বেঁধে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আছি। এ অবস্থায় সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে প্রতিদিন দুইবার তলিয়ে যাচ্ছে এলাকা।’ তারা বলেন, আমরা যাতে আবারো ভিটের ওপর বসতবাড়ি নির্মাণ করতে পারি সেজন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার। তারা সাগরে বিলীন হওয়া বেড়িবাঁধ টেকসইভাবে নির্মাণেরও জোর দাবি জানান।পেকুয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ চৌধুরী রাজু  বলেন, সমুদ্র তীরের রাজাখালী, মগনামা, উজানটিয়া ও পেকুয়া সদর ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডবে। আমি এসব ইউনিয়নের সিংহভাগ গ্রাম পরিদর্শন করেছি। এ সময় দেখেছি করুণ চিত্র। এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে ঘূর্ণিঝড়ের ছোবল লাগেনি। গ্রামীণ অবকাঠামো, বসতবাড়ি, বেড়িবাঁধ কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তিনি আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের দুর্ভোগ স্বচক্ষে দেখলে কান্না এসে যায়। হাজার হাজার মানুষ এখন বসতবাড়ি হারিয়ে দিশেহারা। কোথায় ঘুমাবে, কী খাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষ। কোথাও এক টুকরো শুকনো জায়গাও চোখে পড়েনি।’ মগনামা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম, উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম, রাজাখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছৈয়দ নূর ও পেকুয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ বলেন, ‘সমুদ্র তীরবর্তী এসব ইউনিয়নের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধগুলো বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় এসব ইউনিয়নে জোয়ারভাটা অব্যাহত থাকায় পাঁচদিন ধরে অনাহারেঅর্ধাহারে রয়েছে মানুষগুলো। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিলি করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সরকারিভাবে।’ চার ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা এই মুহূর্তে বসতবাড়ি হারানো পরিবারগুলোর পুনর্বাসন ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। তারা বলেন,সবদিকে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

Royano-pic-6000000পেকুয়ার ইউএনও মো. মারুফুর রশিদ খান বলেন, আজ বিকেল পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ হিসেবে কয়েক দফায় ৪৪ মেট্রিক টন জি আর চাল ও নগদ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বরাদ্দ পাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিলি করার জন্য জনপ্রতিনিধিদের নামে ছাড় করে দেয়া হয়েছে।

ইউএনও বলেন, সোমবার থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই বসতবাড়ি হারানোদের পুনর্বাসনে যাবতীয় সহায়তা দেয়া হবে। এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত আন্তরিক। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বৃহৎ পরিসরে ত্রাণ তৎপরতাও চালানো হবে। কক্সবাজার(চকরিয়াপেকুয়া) আসনের এমপি মৌলভী মোহাম্মদ ইলিয়াছ গতকাল বুধবার বিকেলে চকরিয়া নিউজকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া পেকুয়া উপজেলার চার ইউনিয়ন সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। এসময় আমার সঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কথা হয়েছে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, আগামী সপ্তাহে পুরোদমে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এজন্য ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন মন্ত্রী। এছাড়া ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও বৃহৎ পরিসরে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দও দেয়া হবে।

 

পাঠকের মতামত: