ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ইসলামি দলগুলোর মাঠে নামার প্রস্তুতি

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও আলেম-ওলামাদের মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেবে অধিকাংশ দল

তারিকুল ইসলাম ::
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সক্রিয় হচ্ছে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আলেম-ওলামাদের মুক্তিসহ নানা দাবিতে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে অধিকাংশ দল। এ ইস্যুতে কয়েকটি দল ইতোমধ্যে কর্মসূচিও দিয়েছে। ডিসেম্বরে নামবে আরও কয়েকটি দল। কেউ কেউ পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে রাজপথে নামার পরিকল্পনা করছে। একই সঙ্গে চলছে জোট গঠনে নানা তৎপরতাও। বেশ কয়েকটি ইসলামি দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা যায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে মামলা-হামলার ভয়েই মূলত রাজপথে ইসলামি দলগুলোর তৎপরতা কমে যায়। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফের শুরু হয়েছে নানা তৎপরতা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দল নানা ইস্যুতে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে রয়েছে। নয়টি ইসলামি ও সমমনা দল নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টাও করছে চরমোনাই পিরের দলটি। এছাড়া নানা কারণে অতীতে বিভিন্ন সময় আলোচনায় থাকলেও দীর্ঘদিন অনেকটাই আলোচনার বাইরে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যেই সারা দেশে নিজেদের কার্যক্রম জোরদার করতে যাচ্ছে সংগঠনটি। সভা, সমাবেশ, সম্মেলন, নতুন কমিটি গঠন, পুনর্গঠন এবং দেশব্যাপী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি জানান দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরে ঢাকায় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি। এ সম্মেলনের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুমতি চাইবে। ওইদিন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সমাগম করার টার্গেট নিয়েছে সংগঠনটি।

জানা গেছে, সোমবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতা কারাগারে অন্তরীন নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য শীর্ষ নেতাদের প্রতি অনুরোধ জানান। জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদরিস যুগান্তরকে বলেন, ‘মাঠে ছিলাম, এখনো আছি। গত কয়েক মাস আমাদের কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ ছিল। এখন সারা দেশেই কার্যক্রম জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলের নেতারা যারা কারাগারে আছেন, তাদের মুক্তির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা নির্বাচনমুখী নই। আমাদের সংগঠনের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।’

মীর ইদরিস আরও বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা মহানগর কমিটি সম্প্রসারণ, চট্টগ্রাম মহানগর আহ্বায়ক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় বৃহৎ আকারে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন আয়োজনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া কারাবন্দি হেফাজত নেতাকর্মীদের মুক্তি ও হেফাজতের নামে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর আমিরে হেফাজতের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।’

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের যুগান্তরকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার দাবিসহ নানা ইস্যুতে আমরা দেশব্যাপী কর্মসূচি পালন করেছি। আগামীতেও কর্মসূচি থাকবে। আসলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যতীত বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ হয় না। এই সরকার ১৪ বছর ধরে তা তাদের আচরণে প্রমাণ করেছে। এই সরকারের ওপর দেশের জনগণ এখন চরম ক্ষুব্ধ। আশা করছি সব বিরোধী দল কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে দাবি আদায়ে আমরা সফল হব।’

বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯। এর মধ্যে ইসলামি বা ইসলামপন্থি দল ১০টি। নিবন্ধনের বাইরে ইসলামি দল বা সংগঠন কতগুলো, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামি দলগুলো হচ্ছে-ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, জাকের পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। এ বিষয়ে একটি মামলা এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (একাংশ)। আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটে রয়েছে তরিকত ফেডারেশন। ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এক সময় বিএনপির জোটে ছিল। বর্তমানে তারা স্বতন্ত্র অবস্থানে। যদিও এখনো খণ্ডিত একটি অংশ ২০ দলে রয়েছে। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও জাকের পার্টিও স্বতন্ত্রভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

জানা গেছে, আরেক বৃহৎ দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও কর্মসূচি দিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ, নির্দলীয় জাতীয় সরকারসহ নানা ইস্যুতে জনমত সৃষ্টিতে দলটির শীর্ষ নেতারা সারা দেশে সফর করছেন। জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘বন্যার কারণে সিলেট ছাড়া আমরা সব বিভাগে সমাবেশ করেছি। এছাড়াও মহানগর ও জেলায়ও বিভিন্ন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা মাঠে আছি, থাকব। বাস্তবতা হচ্ছে দেশে দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। অতএব একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় সরকার প্রয়োজন। যাতে সব নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, ভোটের পরিবেশ ফিরে আসে, ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়। আগামী দিনে এ দাবিতে আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি থাকবে। আন্দোলনে নামার আগে জনগণকে উদ্ধুব্ধ করতে এখন শীর্ষ নেতারা সারা দেশ সফর করছেন’।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আব্দুল মালিক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাব না। আমরা এই সরকারের পদত্যাগ চাই। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। দাবি আদায়ে আগামীতে আন্দোলনের জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।’ বাংলাদেশ মুসলীম লীগের (বিএমএল) মহাসচিব অ্যাডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র উদ্ধার ও গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনে যুগপৎ আন্দোলন হোক, আর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই হোক আমরা আছি। পরিস্থিতির প্রয়োজনে একক সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মসূচি দিতে হলেও আমরা দেব।’ যুগান্তর

পাঠকের মতামত: