ঢাকা,মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক

সম্রাটের কামড়ে গুরুতর অসুস্থ নদী, সিংহ দম্পতির সংসারে অশান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বিপরীত লিঙ্গের সিংহ রয়েছে দুই জোড়া। তন্মধ্যে সম্রাট ও নদী দম্পতির মধ্যে পারিবারিক কলহ শুরু হয় গত ২ ফেব্রুয়ারি।

নির্দিষ্ট বেস্টনীতে থাকাবস্থায় ওইদিন তারা মারামারিতে (কামড়াকামড়ি) লিপ্ত হলে উভয়েই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তবে বেশি চোট পায় পুরুষ সিংহ সম্রাট। তখন পার্কের বন্যপ্রাণি হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইন শেডে আলাদা করে রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলে সুস্থ হয়ে উঠে উভয়েই।

কিন্তু ১৭ দিনের মাথায় এই দম্পতি বেস্টনীতে সঙ্গ নিরোধকালে (সেক্সুয়াল মিট) পূর্বের আঘাতের প্রতিশোধ নেয় পুরুষ সিংহ সম্রাট। প্রচণ্ড মারামারিতে লিপ্ত হয় সম্রাট ও নদী। এতে এবার বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সিংহ নদীর গলার নিচে রক্তাক্ত জখম হয়। এর পর থেকে সেই ক্ষতস্থান দিয়ে অনবরত ঝরতে থাকে পানি।

এই যাত্রায়ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা পার্ক কর্তৃপক্ষ উভয়ের চিকিৎসা করায়। তন্মধ্যে পুরুষ সিংহ সম্রাট পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেও অবস্থার অবনতি হতে থাকে স্ত্রী সিংহ নদীর।

এই অবস্থায় পার্ক কর্তৃপক্ষ সবিস্তারে লিখিতভাবে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন এবং এর পর ২২ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি দফায় দফায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও উন্নতি ঘটেনি নদীর।

ক্ষতস্থান থেকে পানি ঝরা বন্ধ না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী আহত সিংহ নদীর চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেন।

কমিটিতে ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সাইয়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডাক্তার বিবেক চন্দ্র সূত্রধরকে প্রধান করা হয়। কমিটিতে সদস্য রয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুপন নন্দী, ভেটেরিনারি সার্জন হাতেম সাজ্জাদ জুলকার নাইনসহ পাঁচজন।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সাইয়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডাক্তার বিবেক চন্দ্র সূত্রধর সিংহ নদীর চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকেরা চকরিয়া নিউজকে জানান, মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে দফায় দফায় চিকিৎসা সেবা প্রদানের পরও দিন দিন খাবার গ্রহণ একেবারেই কমিয়ে দেয় সিংহ নদী। অনবরত মুখ থেকে লালা বের হতে থাকে তার।

এতদিন একটু একটু খাবার গ্রহণ করলেও সর্বশেষ ২৭ মার্চ থেকে খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই সিংহটি জিহ্বা বের করে রাখে এবং মুখ থেকে লালা ঝরার পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দুইজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসহ মেডিক্যাল বোর্ডের অন্য সদস্যরাও ব্যাপক চিকিৎসা কার্যক্রম চালু রাখলেও অবস্থার কোন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু দিন দিন আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে সিংহ নদী।

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম দৈনিক চকরিয়া নিউজকে জানান, সঙ্গ নিরোধকালে মারামারিতে লিপ্ত হয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া সিংহ নদীর উন্নত চিকিৎসায় ইতোমধ্যে দুইবার মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী অসুস্থ সিংহ নদীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। একইসাথে ২৮ মার্চ সিরাম ও রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে প্রেরণ করা হয়।

পরবর্তীতে ১২ এপ্রিল ল্যাবের পরীক্ষার ফলাফল এবং মেডিক্যাল বোর্ডের মতে সিংহ নদীর শরীরে ভাইরাল ইনফেকশন (viral infection) হয়েছে। যা Feline immunodeficiency virus/Feline leukemia virus হিসেবে শনাক্ত হয়।

পার্ক কর্মকর্তা আরো জানান, ল্যাবের ফলাফল এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ভাষ্যানুযায়ী-সিংহ নদীর বর্তমান অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। যে কোন মুহূর্তে সিংহ নদী মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই ধরা পড়া ভাইরাসের ব্যাপারে আরো বেশি নিশ্চিত হতে ফের পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

পার্ক কর্মকর্তা মাজহার বলেন, ‘চিকিৎসা প্রদানসহ সিরাম ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য ইতোপূর্বে দুইবার সিংহ নদীকে অবচেতন করা হয়। পহেলা এপ্রিল অবচেতন করার পর চেতনা ফিরতে প্রায় ৫ ঘন্টা সময় লেগে যায়। বর্তমানে সিংহটির অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। ২৭ মার্চ হতে সে পানি ছাড়া অন্য কোন খাবারও গ্রহণ করেনি। তাই নতুন করে নমুনা সংগ্রহের জন্য অবচেতন করা হলে তা চরম ঝুঁকিপূর্ণ এবং চেতনা ফিরে না আসার আশঙ্কাই বেশি বলে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞা ডাক্তারেরা। এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে অবহিত করা হয়েছে।’

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা এবং বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী দৈনিক চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘মারামারিতে লিপ্ত এবং আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সিংহ নদীর চিকিৎসায় দুইবার মেডিক্যাল বোর্ড গঠনসহ দুইজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে যাবতীয় চিকিৎসাসেবা প্রদানের কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে।

সিরাম ও রক্তের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে একটি ভাইরাসও শনাক্ত হয়েছে শরীরে। তাই ভাইরাসটির ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হলে ফের নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে প্রেরণ করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে সিংহ নদী এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, তৃতীয়বার ট্র্যাঙ্কুলাইজ করাটাও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। অবচেতন করা হলে এটির আর চেতনা ফিরে না আসারও আশঙ্কা রয়েছে। এর পরও সিংহ নদীর চিকিৎসায় কোন হেরফের করা হচ্ছেনা।’

 

পাঠকের মতামত: