ঢাকা,সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মাওলানা আলমগীরের মৃত্যু

ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালকে দায়ী করা হচ্ছে যে কারণে

বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজার ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের ‘অবহেলায় ভরা’ এবং ‘নষ্ট মেশিন’ দিয়ে রিপোর্ট তৈরির কারণে ‘পরিকল্পিত ভাবে এবং সজ্ঞানে, ঠান্ডা মাথায়’ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য, জীবন, অর্থ নিয়ে ব্যবসা করে ‘প্রতারণার মাধ্যমে’ মানুষকে ভুল চিকিৎসা দিয়ে মানবতা ও জনকল্যাণের জন্য ক্ষতিকর ও মারাত্মক অপরাধ করেছে।

কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে দায়ের করা এক মামলায় বাদী এড. মিনারুল কবির আল আমিন এমনতর অভিযোগ তুলেছেন।

এই মামলায় কক্সবাজার ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাহ আলম ও রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ ডা. ওসমানুর রশীদকে অভিযুক্ত করেছেন। মামলার বাদীর দাবি, আসামিদের হাসপাতালের ‘ভূঁয়া আন্দাজী ও ভুলে ভরা রিপোর্ট’ দিয়ে চিকিৎসার কারণে তার বাবা মাওলানা মোহাম্মদ আলমগীরকে হারিয়েছেন। একই সাথে তিনি আর্থিক ভাবে ক্ষতির সম্মুখিন ও প্রতারণা, অপচিকিৎসার সম্মুখিন হয়েছেন।

যদিও ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাহ আলম ও রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ ডা. ওসমানুর রশীদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, সিটিস্ক্যানের ভুল নয়, সঠিক রিপোর্টই দেয়া হয়েছে। মূলতঃ ব্রেন স্ট্রোকের রোগীদের রক্তক্ষরণের চিহ্ন ২৪ ঘন্টার আগে সিটিস্ক্যানে ধরা পড়ে না।

তাদের মতে, ওই রোগী অসুস্থ হওয়ার ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে সিটিস্ক্যান করেছেন। তখন ফিল্মে যে ছবি এসেছে সেই অনুযায়ীই রিপোর্ট দেয়া হয়েছে।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের দুই চিকিৎসক অসুস্থতার ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্রেনে রক্তক্ষরণের চিহ্ন আসবে না বলে দাবি করলেও মামলার বাদীর বাবার চট্টগ্রামে করা সিটিস্ক্যানের সাথে কক্সবাজারে করা সিটিস্ক্যানের সময়ের ব্যবধান মাত্র ১৬ ঘন্টা ৫৫ মিনিট। যা ২৪ ঘন্টার চেয়েও প্রায় ৭ ঘন্টা কম।

সুত্র মতে, কক্সবাজার ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালে সিটিস্ক্যান করা হয় ৬ অক্টোবর বিকেল ৪টা ৩৪ মিনিটে। আর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে সিটিস্ক্যান করা হয় ৭ অক্টোবর সকাল ৯টা ২৯ মিনিটে।

প্রায় ১৭ ঘন্টা ব্যবধানে করা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে করা সিটিস্ক্যানের রিপোর্টে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, মাওলানা মোহাম্মদ আলমগীরের ‘মেজর স্ট্রোক হয়েছে’। যার ফলে ব্রেইনে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।

তখন ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা মামলার বাদী, অসুস্থ মাওলানা আলমগীরের ছেলে মিনারুল কবির আল আমিনকে জানান, এমন অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসা এক প্রকার মিরাকল বৈ কিছুই নয়।

মামলার এজাহার সুত্র মতে, ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে মাওলনাা মোহাম্মদ আলমগীর সুস্থ শরীরে বাড়ি থেকে বের হন। তিনি শহরের হিলটন কক্স হোটেলে ওয়ায়েজী বক্তাদের সংগঠন ‘মুফাস্সির পরিষদে’র একটি প্রোগ্রামে যান। সেখানেই সকাল ১০টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে বাদী ও তার অন্য আত্মীয় স্বজনরা দ্রুত তাকে ওই হোটেল থেকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আগে থেকে হার্টের সমস্যা থাকায় হাসপাতালে তাকে সিসিইউতে ভর্তি করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা দ্রুত বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন। ওই সময় (বেলা ১টার পর) সদর হাসপাতালে সিটিস্ক্যান করা সম্ভব নয় বলে জানানোর পর রোগীকে সিটিস্ক্যান করতে ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালে আনা হয়।

সেখানে আনার পর বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার (এ বিষয়ে বিস্তারিত পরবর্তী প্রতিবেদনে) পর সিটিস্ক্যান করা হয়। বিকেল পাওয়া সিটিস্ক্যানের ফিল্ম ও রিপোর্ট পাওয়া যায়। ওই সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট করেন ডা. ওসমানুর রশীদ।

ওই রিপোর্ট ও ফিল্ম কক্সবাজার সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকদের দেখানো হলে রিপোর্ট মতে তারা জানান, রোগীর গুরুতর কিছু হয়নি। ব্রেইনের কোন সমস্যা নাই। হার্টের একটু সমস্যা আছে।

কিন্ত দীর্ঘ সময় পরও মাওলানা আলমগীরের জ্ঞান ফিরে না আসায় বাদী আল আমিনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা বারবার চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা রোগীর নিকটাত্মীয়দের জানান, রোগীর এটা হার্টের সমস্যা না, যদি হার্টের সমস্যা হতো তাহলে এতক্ষণে জ্ঞান ফিরে আসতো। যেহেতু জ্ঞান ফিরছে না, তাহলে আর্থিক সামর্থ থাকলে যেন চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

বাদী এড. আল আমিন মোবাইলে চট্টগ্রাম থেকে আইসিইউ এ্যাম্বুলেন্স এনে ওইদিন রাত ৩টার দিকে অজ্ঞান অবস্থায় মাওলানা আলমগীরকে নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করেন। পরদিন ৭ অক্টোবর সকাল ৭টার দিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে পৌঁছায় এ্যাম্বুলেন্স।

মামলার বাদীর মতে, ওখানে ভর্তির পর মাওলানা আলমগীরের আবারও সিটিস্ক্যান করা হয়। এক ঘন্টার মধ্যেই সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট পাওয়া যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তখন বাদীকে ডেকে বলেন, আপনার বাবার মেজর স্ট্রোক হয়েছে। যার ফলে ব্রেইনে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের ওই চিকিৎসক বাদী আল আমিনকে বলেন, ‘এমন অবস্থা থেকে ফিরে আসা এক প্রকার মিরাকল বৈ কিছুই নয়।’

ওই হাসপাতালের আইসিইউতে দুইদিন চিকিৎসার পর মাওলানা আলমগীরকে বাংলাদেশের ব্রেইনের চিকিৎসার সর্বোচ্চ বিশেষায়িত হাসপাতাল ঢাকার শেরে বাংলা নগর এলাকার ‘নিউরো মেডিকেল সায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত প্রায় ২টা ১৫ মিনিটে ওই হাসপাতালে পৌঁছার পর হাসপাতালের স্ট্রোক বিভাগে ভর্তি করা হয়। ওখানে আবারও চেকআপ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা বাদীকে ফোন করে ডেকে নিয়ে জানান, তার বাবার মস্তিস্কে প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।

তারা বাদী এড. আল আমিনকে জানান, কক্সবাজারে করা ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের রিপোর্টগুলো সঠিক নয় এবং তা আন্দাজী রিপোর্ট।

এ ব্যাপারে ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট করা রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ ডা. ওসমানুর রশীদ জানান, রিপোর্টটির আসল কপি পেলে তিনি বলতে পারবেন তিনিই সিটিস্ক্যানের রিপোর্টটি করেছিলেন কিনা।

তবে তিনি বলেন, এ ধরণের রোগের ক্ষেত্রে ব্রেইনে রক্তক্ষরণ হলেও ২৪ ঘন্টা আগে তা সিটিস্ক্যানে ধরা পড়ে না। ওই রোগী অসুস্থতার ৩-৪ ঘন্টার মধ্যেই সিটিস্ক্যান করেছেন।

ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাহ আলম বলেন, ডা. ওসমানুর রশীদ একজন দেশসেরা ডাক্তার। তিনি এক চান্সে এফসিপিএস পাস করেছেন। তার রিপোর্টের ওপর অধিকাংশ ডাক্তারই নির্ভরশীল।

তিনি দাবি করেন, ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের সিটিস্ক্যানের যে রিপোর্ট ডা. ওসমানুর রশীদ দিয়েছেন তা সঠিকই দিয়েছেন। বরং তিনি যদি ব্রেইনে রক্তক্ষরণের রিপোর্ট দিতেন তা হতো ভুল রিপোর্ট।

ডা. শাহ আলমের মতে, তার হাসপাতালের সিটিস্ক্যান মেশিন অত্যন্ত অত্যাধুনিক। তিনি নিজেই জার্মানি গিয়ে সিমেন্স কোম্পানি থেকে এই মেশিন বানিয়ে এনেছেন।

এদিকে মামলার বাদী এড. মিনারুল কবির আল আমিন জানান, যদি চট্টগ্রামে সিটিস্ক্যান রিপোর্টে ব্রেইনে রক্তক্ষরণ পাওয়া যায়, তাহলে কক্সবাজারে কেন রক্তক্ষরণ ধরা পড়বে না?

তিনি বলেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সিটিস্ক্যান ২৪ ঘন্টার মধ্যেই করা হয়েছে। তাই ডাক্তার ও ফুয়াদ আল খতীব হাসপাতালের বক্তব্য সঠিক নয়।
তিনি দাবি করেন, বাবার মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য তিনি মামলা করেননি। জনস্বার্থে তিনি এই মামলা করেছেন।

পাঠকের মতামত: