ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

১৫ টন চাল আত্মসাত, নাটের গুরু ইউএনও না কি ইউপি চেয়ারম্যান!

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া ::  কক্সবাজারের পেকুয়ায় করোনা পরিস্থিতিতে টৈটং ইউনিয়নের শ্রমজীবী ও হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ত্রাণের ১৫ টন চাল। কিন্তু ওই চাল বিতরণ না করে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাঈকা সাহাদাত ও টৈটং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর যোগসাজসের মাধ্যমে কালোবাজারি করেছে বলে দুইজনের ছবিসহ গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব হয়ে ওঠে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা এবং জেলা প্রশাসনের দৌঁড়ঝাপের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার রাতে শুধুমাত্র চেয়ারম্যান জাহেদকে আসামি করে পেকুয়া থানায় একটি মামলা রুজু করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম।

বুধবার দুপুরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কারাদেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানতে পারলাম টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদকে আওয়ামীলীগ থেকেও বহিস্কার করা হয়েছে।

সচেতন লোকজনের প্রশ্ন হচ্ছে, এমন কোনো পরিস্থিতি টৈটং ইউনিয়নে সৃষ্টি হয়েছিল, যার কারণে শুধুমাত্র ওই ইউনিয়নের জন্য ১৫ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। যদিও বিশেষ কারণে ইউএনও এসব চাল বরাদ্দ দিয়ে চুপ থেকেছিলেন কেন? কেনই বা তিনি (ইউএনও) এসব চাল যথাযথভাবে দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে কি-না তা তদারকি করেননি। এক্ষেত্রে ত্রাণের এই চাল নয়-ছয়ের ঘটনার নাটের গুরু ইউএনও না-কি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। সেই রহস্য বের করার দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আবারো সরব হয়ে উঠেছে। অনেকেই বলছেন, ঊর্ধতন কর্মকর্তারা শুধুমাত্র চেয়ারম্যানের ওপর দোষ চাপিয়ে ইউএনওকে বাচিয়ে নিয়েছেন। যা এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, গতবছর ঘুর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানলে পেকুয়া উপজেলার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ৪০ টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই ৪০ টন চাল থেকে ২৫ টন চাল ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিলি করে বাকী ১৫ টন চাল রেখে দেওয়া হয়। এবার মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে নতুন করে পেকুয়ার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে প্রায় ৯০ টন মতো চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই সুযোগে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সময় রেখে দেওয়া ১৫ টন চাল টৈটং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর নামে উপ-বরাদ্দপত্র দিয়ে তার মাধ্যমে খাদ্যগুদাম থেকে উত্তোলন করে কালোবাজারে বিক্রি করে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন ইউএনও। এখানে চেয়ারম্যান উপ-বরাদ্দপত্রে স্বাক্ষর এবং খাদ্যগুদাম থেকে উত্তোলন করলেও তিনি বলির পাঁঠা হয়েছেন মাত্র।

১৫ টন চাল উত্তোলনের পর কালোবাজারী এবং আত্মসাতের অভিযোগ এনে টৈটং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে পেকুয়া থানায় মামলা করেন নবনিযুক্ত উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আমিনুল ইসলাম।

চাল বিতরণের মাষ্টার রোল জমা প্রদান প্রসঙ্গে পিআইওর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান বলেছেন, তিনি চাল বিতরণ করেছেন। কিন্তু মাস্টাররোল জমা দিতে পারেননি। হয়তো নানা ব্যস্ততার কারণে তিনি মাস্টাররোল জমা দিতে সময় পাননি। এর পরেও অভিযোগ যেহেতু উঠেছে, সেহেতু ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে।’

অভিযুক্ত টৈটং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি চাল উত্তোলনের পর ইউনিয়নের হতদরিদ্র এবং শ্রমজীবী প্রায় ২২০০ পরিবারের মাঝে চাল বিতরণ করেছি। যার মাস্টার রোল আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। এমনকি সেই মাস্টাররোল পিআইওর কাছে জমা দিয়ে প্রাপ্তিস্বীকার পত্রও নিয়েছি। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে একটি দুষ্টুচক্র আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। যার ফল হিসেবে ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করেছেন এবং পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়েছে।’

পেকুয়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে একমাত্র টৈটং ইউনিয়নের জন্য একসঙ্গে ১৫ টন চাল বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক বলেও মনে করছেন একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। অন্য কোন ইউনিয়ন একসঙ্গে এতটন চাল বরাদ্দ পায়নি কেন?

তাদের ভাষ্য মতে- শুধুমাত্র আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই ইউএনও টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সঙ্গোপনে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সময় বরাদ্দকৃত চাল করোনা পরিস্থিতিতে কালোবাজারি করে টাকা হাতিয়েছেন। এখন শুধুমাত্র চেয়ারম্যানের ঘাঁড়ে দোষ চাপিয়ে ইউএনও সাধু সেজেছেন।

এদিকে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার গত সোমবার সরজমিন পেকুয়ায় আসেন চাল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এ সময় তিনি বলেন, ‘১৫ টন চালের উপ-বরাদ্দ যে চেয়ারম্যানের নামে দেওয়া হয়েছে, তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে পেলেই মূল রহস্য হয়তো বের হয়ে আসবে, চালগুলো কোথায় গেছে।’

তবে পেকুয়ার ইউএনও সাঈকা সাহাদাতের দাবি, চালগুলো যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নামে উপ-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে উত্তোলনের পর সেই চাল কি করেছেন তা তিনি অবগত নন। বিষয়টির যথাযথ অনুসন্ধান চলছে।

পেকুয়ার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে শুধুমাত্র টৈটং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নামে একসাথে ১৫ টন চাল বরাদ্দ এবং এই চাল গায়েবের পেছনে ইউএনওর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানার জন্য তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ফোন না ধরায় এই বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পাঠকের মতামত: