ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

১১ মাস পর আজ দেশে ফিরল কক্সবাজারের কিশোরী আসমা: ওসি ফেরদৌস

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি ::  ঘটনাটা ২০১৯ সালের জুলাই মাসের। খুব সম্ভবত তারিখটা ছিলো ১১। বিদেশের একটি ফোন নাম্বার থেকে অফিসার ইনচার্জ, কুতুবদিয়া থানার সরকারি মোবাইল নাম্বারে কল আসে। কান্ট্রি কোড দেখে বুঝে নিলেন ওসি ফোন নাম্বারটা আমাদের প্বার্শবর্তী দেশ ভারতের। সরকারি ফোনে সচরাচর এমন কল না আসায় একটু অবাক হলেন ওসি।

কথাগুলো জানালেন কুতুবদিয়া থানার ওসি মো. দিদারুল ফেরদৌস।

একরকম বিস্ময়চিত্তে রিসিভ করে হ্যালো বলার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে একটা ভরাট কন্ঠের ভদ্রলোক হিন্দী ভাষায় আমি অফিসার ইনচার্জ, কুতুবদিয়া কিনা জিজ্ঞেস করলেন। জাতিসংঘ মিশনে থাকাকালে ভারতীয়দের সাথে কাজ করার সুবাধে ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে খুব একটা সমস্যা হলো না। তারপর তিনি যা জানালেন তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

শোনার পর আমার মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা। তিনি জানালেন আসমা বেগম নামের এক কিশোরী যার বাড়ি কুতুবদিয়ায়, আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের শিকার হয়ে বিভিন্ন হাত ঘুরে আরো কিছু মেয়ের সাথে ট্রেনে করে গুজরাটের আহমেদাবাদ যাচ্ছে।

মেয়েটিকে দেখে লোকটির সন্দেহ হয়, তাই তিনি মেয়েটির সাথে কথা বলে এবং জানতে পারে মেয়েটির বাড়ি বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায়। সে চট্টগ্রাম থেকে মানব পাচারের শিকার হয়েছে। আমি তাৎক্ষণিক লোকটিকে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানায় জানাতে বলি। আমার পরামর্শ মত লোকটি এই বিষয়ে থানায় জানালে সংশ্লিষ্ট আদালাজ থানার পুলিশ সদস্যরা আসমাসহ ৮ জন মেয়েকে উদ্ধার করে স্থানীয় Children Home For Girls, Odhav,Ahmedabad,Gujrat নামক শিশু আশ্রমে স্থানান্তর করে।

এইদিকে আমি মেয়েটির মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করি। তাঁরা জানায় আসমা চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীতে একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করত। সাড়ে পাঁচ মাস আগে চাকরিতে যোগদানের জন্য সে কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে চলে যায়। এরপর মা-বাবার সাথে খুব কমই কথা হতো। কিন্তু ১৫ দিনে আগে হঠাৎ করে আসমা ফোন করে তার মা-বাবাকে বলে ‘আমার আশা করো না, আমার জন্য দোয়া করো’।

মেয়ের মা-বাবার কাছ থেকে এসব শোনার পর যখনই কিছুটা আশাহত হলাম ঠিক তখনই আশার আলো দেখালেন ডাঃ হার্ষা আগারওয়াল। যিনি আহমেদাবাদের শিশু আশ্রমে সাইকোলজিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ডাঃ আগারওয়ালের সাথে লম্বা সময় ধরে কথা হলো। বিস্তারিত আলাপকালে তিনি মেয়েটিকে কিভাবে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যায় সে ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা চাইলেন আর আমি উনাকে আশ্বস্ত করলাম। মেয়েটিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমাদের চেস্টার কমতি থাকবে না।

এরপর আমি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে যোগাযোগ করলাম। ‘রাইটস যশোর’ নামের এক এনজিও’র কর্ণধার বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক এর সাথে। উনারা মানবপাচারের শিকার হওয়া লোকদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কাজ করেন। তিনি জানালেন মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠান সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

এরপর শুরু হলো আসমা নামের কুতুবদিয়ার মেয়েটিকে তার মাতৃকোলে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের কর্মযজ্ঞ।
যোগাযোগ করা হলো ভারতে অবস্থিত কনস্যুলেটের সাথে তাঁরা কথা বললেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে। আসমাসহ বাংলাদেশের ৩ জন মেয়ের পরিচয় এবং তাদের অতীত বর্তমান জানার জন্য শুরু হলো গোয়েন্দা তৎপরতা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখায় আসমার আইনগত প্রত্যাবসনের জন্য তার নাম-ঠিকানা, প্রাক-পরিচিতি এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে গোপন প্রতিবেদন চাওয়া হয়।

এতসবের মাঝেও আমার, ডাঃ হার্ষা আগারওয়াল আর বিনয় মল্লিকের মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিলো। আমরা আসমাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে অবহিত করতাম। গত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে পুলিশ সুপার, জেলা বিশেষ শাখা,কক্সবাজার এর মাধ্যমে কুতুবদিয়া থানা আসমা এবং তার পরিবার সম্পর্কে তথ্য প্রেরণের একটি আদেশ পাই। কুতুবদিয়া থানা পুলিশ যেহেতু আগে থেকেই এ বিষয়ে অবগত আছে এবং আমাদের পরোক্ষ সহায়তায় এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তাই আমরা দেরি না করেই দ্রুত এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিলাম।

অবশেষে, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষে আমাদের কষ্ট সফলতার মুখ দেখল। চলতি মাসের ১২ তারিখে আসমা দেশে ফিরে আসে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে বেনাপোল বন্দর থানায় হস্তান্তর করলে সেখান থেকে ‘রাইটস যশোর’ মেয়েটিকে জিম্মায় গ্রহণ করে আমাকে জানায়। আমি মেয়ের বাবা জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য যশোর পাঠিয়ে দেই। আজ ১৬ জুন দুপুর ১ টার সময় পিতা জাহাঙ্গীর আলম তার মেয়ে আসমাকে নিয়ে কুতুবদিয়ায় ফিরে আসে।

পাঠকের মতামত: