ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

স্বজন হারানোর কান্না শোনা যায় এখনো

নিজস্ব প্রতিবেদক :: ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে মহাপ্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড় ‘হ্যারিকেন’ চট্টগ্রাম–কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানার ৩১ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এই দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস এক রাতেই কেড়ে নেয় চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার উপকূলের লাখো মানুষের প্রাণ।

সেদিন কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার অন্তত ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে প্রাণ যায় লাখ লাখ গবাদি পশুরও। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ উপকূলীয় এলাকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিণত হয় বিরাণ ভূমিতে। সেই রাতের কথা মনে উঠলে এখনো শিউরে ওঠেন উপকূলের মানুষ। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল আসার আগে–পরে আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে সেই ভয়াবহ স্মৃতি তাড়া করে উপকূলবাসীকে। স্বজন হারানোর বেদনায় নীরবে অশ্রুপাত করেন তাঁরা। এই দিনের স্মরণে উপকূলের বিভিন্ন সংগঠন স্মরণসভাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কর্মসূচি পালন করে আসছে। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ৩১ বছর পূর্ণ হলেও উপকূলীয় মানুষের জান–মালের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ টেকসই করা যায়নি। মাঝেমধ্যে বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও তা প্রতিবছর জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে যায়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরদিন চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকাজুড়ে মানুষ আর গবাদি পশুর লাশে একাকার হয়ে পড়েছিল। ওই সময় চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন, কারিতাস বাংলাদেশসহ বেসরকারি সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিরা অন্তত ১৫ দিনব্যাপী এসব লাশ উদ্ধার করে গণকবর দেয়। ৩১ বছরের ব্যবধানে উপকূলীয় এলাকার এসব গণকবরের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে। এরপর বিভিন্ন সময় দেশি–বিদেশি অর্থায়নে শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়। কিন্তু দেখভালের অভাবে এসব আশ্রয়কেন্দ্র দিন দিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ১৯৯১ সালের পরে নতুন করে আর কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়নি। ফলে চকরিয়া–পেকুয়ার পাঁচ লাখ মানুষ এখনো বসবাস করছেন চরম ঝুঁকিতে।

চকরিয়া উপজেলার বদরখালীর খালকাচাপাড়ার পাড়ার সত্তরোর্ধ্ব আমিনুল ইসলাম বলেন, যারা ওই দিন সকাল বেলায়ও টাকা–সম্পদে ধনী ছিলেন, তারাই রাতের মধ্যে ফকির হয়ে যান। তিনি আরো বলেন, জলোচ্ছ্বাসের পরে উপকূলবাসীর গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলা ভরা ধান কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তখন ৮০ ভাগ মানুষই জীবন বাঁচানোর তাগিদে সরকারি–বেসরকারি ত্রাণ নির্ভর হয়ে পড়ে।

পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পেকুয়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে মগনামা, রাজাখালী ও উজানটিয়া। এরমধ্যে একেবারে সাগরগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে মগনামার কিছু অংশ।

কক্সবাজার–১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, উপকূলের মানুষকে রক্ষায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য কাজ চলমান রয়েছে। অবশ্য পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়নের বিশাল এলাকা আগে অরক্ষিত থাকলেও সেখানে দেশের প্রথম বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন নৌ–ঘাটি স্থাপন হওয়ায় টেকসইভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বেড়িবাঁধ। এতে অনেকবছরে দুঃখ লাঘব হয়েছে উপকূলের মানুষের।

এমপি জাফর আলম আরো বলেন, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকার মানুষ যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের জান–মাল রক্ষা করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আগামী ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান অনুযায়ী সমুদ্র উপকূল রক্ষায় অনেক উচ্চতায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজও শুরু হবে আগামীতে।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ডক্টর তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, কক্সবাজারের উপকূলজুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আগে বরাদ্দ প্রাপ্তি নিয়ে যেসব সমস্যা দেখা দিতো বর্তমানে সেই অবস্থা নেই।

নির্বাহী প্রকৌশলী আরো বলেন, পুরো কক্সবাজার উপকূলে বেড়িবাধ নির্মাণ করা হয়েছিল আশির দশকে। তখন সমুদ্রপৃষ্ট থেকে বেড়িবাঁধের উচ্চতা ছিল ৫ পয়েন্ট ৫ মিটার। তবে আগামীতে সরকারের ডেল্টা প্ল্যান অনুসারে এসব বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায়। সেই হিসেবে বর্তমানে স্থিত ৫ পয়েন্ট ৫ মিটার থেকে বাড়িয়ে আরো দেড় মিটার উচ্চতায় বেড়িবাঁধগুলো নির্মিত হবে। এটি হলেই সবকিছু রক্ষিত হয়ে যাবে। আমরা সেভাবেই এগুচ্ছি।

 

পাঠকের মতামত: