কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
লবণের দাম বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে- কিন্তু বাড়ছে না চাষিদের ঘামের দাম। জমিদার থেকে দালাল, দালাল থেকে মিল মালিক ঘাটে ঘাটে কমিশনের পর শেষ পর্যন্ত লবণ চাষিদের হাতে গিয়ে যে দাম জমা পড়ে তা দিয়ে উৎপাদন খরচ কোনমতে তোলা যায় কিন্তু লাভের আশা যেন দুরাশা গতর খাটা চাষিদের। অথচ দেশের চাহিদার সব লবণ উৎপাদন করেন সেই ভাগ্যবঞ্চিত প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক চাষি। তাদের দাবি সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে লবন কিনে নায্যমূল্য নিশ্চিত করে এবং তা যেন লবণ বোর্ড গঠন করে দুর করা হয়। লবণ চাষিদের অভিযোগ, লবণের দর নিয়ন্ত্রন মিল মালিকদের হাতে থাকার কারনে তারা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন করে ও চাষিরা তাদের নায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অনেকে মাঠে নামতে অনাগ্রহ দেখায়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন কক্সবাজার এর ডিজিএম দিলদার আহমদ চৌধুরী জানান, দেশের চাহিদার সব লবণ উৎপাদন হয় কক্সবাজারের ৭ উপজেলা এবং চট্টগ্রামের বাশঁখালী উপজেলায়। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে ৬৩.৩০ হাজার একর জমিতে প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিকটন। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৪.৫৬ লাখ মে.টন। আবহাওয়া লবণচাষ উপযোগি হওয়ায় এবং শীতের শুরুতে কুয়াশা কম থাকার কারনে এ বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বলে জানিয়েছেন চাষিরা। দেশে এ বছর লবণের চাহিদা নির্ধারন করা হয়েছে ১৬.২১ লাখ মে.টন। এ বছর দেশে ৪৩ হাজার ৮৮জন চাষি ৬৪ হাজার ১২৫ একর জমিতে লবন চাষের জন্য মাঠে নামে। গেল ২ বছরে খারাপ আবহাওয়ার কারনে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছেন বিসিকের কর্মকর্তারা। ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে দেশের চাহিদা ১৬.৫৮ লাখ মে.টন হলেও উৎপাদন হয় ১৫.৫৫ লাখ মে.টন। পাশাপাশি ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে চাহিদা ছিল ১৬.৫৮ লাখ মে.টন কিন্তু উৎপাদন হয় ১২.৮২ লাখ মে.টন। ফলে গেল ২ বছরে চাহিদা পুরণ না হওয়ার পেছনে খারাপ আবহাওয়া, লবণের দাম কম হওয়াকে দায়ি করছেন লবণ সংশ্লিষ্টরা।
জানাযায়, দেশের চাহিদার সব লবণ উৎপাদন হয় কক্সবাজার জেলার ৭ উপজেলা যথাক্রমে কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া , রামু ও টেকনাফে। এছাড়া চট্টগ্রামের বাশঁখালী উপজেলায়। তবে আশার কথা হচ্ছে চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৫০ একর জমি লবণ উৎপাদনের আওতায় আনা হয়েছে।
এদিকে লবণের বাম্পার উৎপাদন হলেও বর্তমান দাম স্থির থাকায় সংশয়ে রয়েছেন চাষিরা। মওসুমের শুরুতে লবণের দাম মন প্রতি ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা ছিল। তবে বর্তমানে ৪’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
লবণ উৎপাদন বৃদ্ধির কারনে মওসুমের মাঝামাঝি এসে দাম খানিকটা কমে ২৫০ টাকায় মনে বিক্রি হয়েছিল। খুচরা মন প্রতি ৩শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সদরের ভারুয়াখালীর প্রান্তিক চাষি মোহাম্মদ জাকারিয়া। তিনি জানান, দাম ভাল হলেও জমির দাম, শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধির কারনে কোনমতে পোষাতে হচ্ছে। তবে দাম না কমলে শেষশেষ চাষিরা লাভবান হবেন।
এদিকে কুতুবদিয়ার প্রান্তিক লবনচাষি সরওয়ার কামাল জানান, লবনের উৎপাদন বাড়লে ও চাষিদের দুঃখ থামছেনা। বেশিরভাগ চাষিরা পরের জমি চাষ করার কারনে তারা জিম্মি জমিদার, দালাল, দাদন, সুদিমহাজনের কাছে। লবনের দাম থাকার সুফল পাচ্ছে অভিজাত শ্রেণি। বিশেষ করে লবণের বাজার দর নিয়ন্ত্রন করে মিল মালিকরা। ফলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দরিদ্র চাষিরা লবণের বাম্পার উৎপাদন করলে ও লাভের টাকা চলে যায় জমিদার, দাদন ব্যবসায়ি, দালাল এবং মিল মালিকদের হাতে। দাম কমার কারনে মিল মালিকরা লবণ মওজুদ করার কারনে অনেক সময় দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয় বলে চাষিদের অভিযোগ।
কক্সবাজারের ও বাশঁখালীর ৪৩ হাজার চাষিদের দাবি লবন শিল্পকে স্থায়ি রুপ দিতে যেন লবন বোর্ড গঠন করা হয়। লবনের দর নিয়ন্ত্রনের জন্য মিল মালিকদের বাদ দিয়ে সরকার যেন দর নির্ধারণ করে দেয়। পাশাপাশি প্রান্তিক চাষিদের যেন সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হয়।
এদিকে ১৯৮২ সালে সদরের ভারুয়াখালী এবং পিএমখালীর লবণচাষিদের জন্য সোনালী ব্যাংক রামু শাখায় ক্ষুদ্র ঋন প্রকল্প চালু করে। এর আওতায় অনেক চাষি ঋন গ্রহন করে। সে সময় টানা ৪ বছর লবন উৎপাদন কম হওয়ায় ঋন পরিশোধ করতে পারেনি। উক্ত ঋন সুদে-আসলে ১০/১৫ বছরে অনেক টাকা হওয়ার কারনে চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাদের দাবি লবণের চাষের জন্য গৃহিত উক্ত ঋন যেন মওকুফ করা হয়। গরমে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে সহায় সম্বল বিক্রি করে পরিবারের জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে গিয়ে লবণচাষিরা পথে পথে হয়রানির শিকার হচ্ছে। সরকার যেন চাষিদের উক্ত পুরনো ঋন মওকুফ করে।
পাঠকের মতামত: