নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর অন্তত ৩০টি পয়েন্টে শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। উত্তোলিত এসব বালু বিভিন্ন স্থানে ফসলি জমির ওপর স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। ড্রেজার, শ্যালো মেশিনের সাথে বড় বড় পাইপ সংযুক্ত করে অনেকদূর পর্যন্তও এই বালু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে বহুমুখী সমস্যা দেখা দিয়েছে।
তন্মধ্যে ফসলি জমি নষ্ট করে ফেলায় সবজিসহ রকমারী ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, নদীর দুই তীরের ভাঙন প্রকট আকার ধারণ করা, নদীর তলদেশে চোরাবালি সৃষ্টি হওয়া, ভূ-গর্ভ থেকে বালু উত্তোলনের ফলে আগামী বর্ষায় ভয়াবহ ভূমিধসের আশঙ্কা ছাড়াও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে মাতামুহুরী নদীর ওপর নির্মিত পালাকাটা ও বাঘগুজারা নামের দুটি রাবার ড্যাম (রাবার ব্যারেজ)। এই ড্যাম দুটির সহায়তায় প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে (চলতি শীত মৌসুম) চাষাবাদের সুবিধার্থে মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা মিঠা পানি ধরে রাখা হয়। পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে চললেও এসব বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর, উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন ধরনের তৎপরতা নেই। এতে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটগুলো দিন-রাত সমানে এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
সরজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং সচেতন লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর বিএমচর, কোনাখালী, পৌরসভার আমান পাড়া, চিরিঙ্গার পালাকাটা, সওদাগরঘোনা, বরইতলীর বাঘগুজারা পয়েন্ট, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ঘুনিয়াসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্টে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনযজ্ঞ। এসব পয়েন্টে শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে বড় বড় পাইপ দ্বারা বালু উত্তোলনের কারণে মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক জায়গা থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলনের কারণে নদীতে সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য চোরাবালি। এতে গোসল, মাছ ধরাসহ প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত চোরাবালিতে তলিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।
সরজমিন আরো দেখা গেছে, পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের আমান পাড়ায় মাতামুহুরী নদীতে অসংখ্য ড্রেজার এবং শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু। এতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ক্ষতি হচ্ছে মাতামুহুরী নদী তীরের ফসলি জমির। আবার ফসল ফলানো জমির ওপর একের পর এক বালুর স্তুপ করে রাখায় গত কয়েকবছর ধরে চাষাবাদও হচ্ছে না বিপুল পরিমাণ জমিতে। এই অবস্থায় নিজেদের জমিতে ফসল ফলাতে না পেরে প্রান্তিক কৃষকেরা মাথায় হাত ওঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চকরিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নের পরিবেশ সচেতন বেশ কয়েকজন চকরিয়া নিউজকে জানিয়েছেন, দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘ ৪৫ বছর পর্যন্ত মাতামুহুরী নদীর দুই পয়েন্টে মাটির বাঁধ (ক্রসবাঁধ) দিয়ে প্রতিবছর ইরি-বোরো চাষের সুবিধার্থে মিঠা পানি ধরে রাখতো। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে প্রতিবছর সরকারকে গচ্চা দিতে হতো কোটি কোটি টাকার। সেই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে নদীর পালাকাটা ও বাঘগুজারা পয়েন্টে দুটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করে। তন্মধ্যে বাঘগুজারা রাবার ড্যামটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাবার ড্যাম।
সম্প্রতি পালাকাটা রাবার ড্যামের একেবারে কাছেই দেখা যাচ্ছে শক্তিশালী এবং অত্যাধুনিক চারটি ড্রেজার। এগুলো পালাকাটা রাবার ড্যামের ওপর দিয়ে পার করিয়ে সওদাগরঘোনায় নেওয়ার জন্য একটি প্রভাবশালী চক্র অপতৎপরতা শুরু করেছেন বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা (এসও) শাহ আরমান সালমান জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই শাখা কর্মকর্তা চকরিয়া নিউজকে বলেন, পালাকাটা রাবার ড্যামের সওদাগরঘোনা পয়েন্টে বালু উত্তোলনের জন্য কে বা কারা চারটি অত্যাধুনিক ড্রেজার এনে রেখেছেন। এসব ড্রেজার রাবার ড্যামের ওপর দিয়ে পার করা হলে রাবার ব্যাগ ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ড সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে ড্রেজারগুলোর প্রতি।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. মাহবুবুল ইসলাম চকরিয়া নিউজকে জানান, চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে সম্প্রতি সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে স্তুপকৃত বালু ও দুটি ট্রাক জব্দ করা হয়। এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও রুজু করা হয়েছে। এর পরও যেখানে এই ধরণের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলবে সেখানে অভিযান চালানো হবে।
একই কথা জানিয়েছেন চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাহাত উজ-জামান। তিনি চকরিয়া নিউজকে বলেন, যখনই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাৎক্ষণিক অভিযান চালানোসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জামাদিও জব্দ করা হয়েছে। আগামীতেও অভিযান অব্যাহতভাবে চলবে।
পাঠকের মতামত: