শুরু হলো প্রতীক্ষিত ড্রেজিং, আনন্দে চকরিয়া-পেকুয়ার ৭ লাখ মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
পার্বত্য বান্দরবানের লামা ও আলীকদমে ভয়াবহ পাহাড় নিধন, বৃক্ষনিধনসহ গাছের গোড়ালি পর্যন্ত উপড়ে ফেলায় প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর তলদেশ ভরাট হতে হতে শুষ্ক মৌসুমে জেগে উঠে বালুভর্তি তলদেশ। এতে বলতে গেলে অনেকটা যৌবন হারিয়ে মৃত অবস্থায় দেখতে হয় নদীর তলদেশকে। প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর এই কান্না থামানোর জন্য ভরাট হয়ে যাওয়া তলদেশ খননের (ড্রেজিং) মাধ্যমে নদীর চিরচেনা যৌবন ফিরিয়ে দিতে গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের একাধিক ভয়াবহ বন্যার সময় সরজমিন পরিদর্শনে এসে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মাতামুহুরী নদীর তলদেশ খননের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ওইসময় মন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন মাঝখানে কয়েকবছর স্তিমিত হয়ে পড়লেও এবার দৃশ্যমান হচ্ছে নদীর তলদেশ খননের কাজ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেওয়া মাতামুহুরী নদী ড্রেজিংয়ের পাইলট প্রকল্পের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩ কিলোমিটার অংশের তলদেশ খননের কাজ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। এতে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার সাত লাখ মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছে। এই পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ বন্যার যে তাণ্ডব দেখতে হতো আগামী বর্ষা মৌসুম থেকে হয়তো এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাবে এখানকার মানুষ। তবে বহুল প্রতীক্ষিত এই নদী খননের কাজে যাতে কোন ধরণের পুকুরচুরি না হয় সেজন্য সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলসহ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের প্রতি জোর দাবি এখানকার মানুষের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি স্থল বান্দরবানের আলীকদম থেকে বঙ্গোপসাগরের সংযোগস্থল কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালী চ্যানেল পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার চর ভরাট এলাকায় খাল খনন ও নদীর দুইতীরের বাঁধবিহীন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত ১০ কিলোমিটার এলাকায় প্রতিরক্ষামূলক বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় পর্যায়ক্রমে এই কাজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪২২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে হলে আলীকদম–লামা, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার নদীর দুই তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত প্রায় সাত লাখ মানুষের জানমাল রক্ষার পাশাপাশি প্রতি বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের ভয়াবহ তাণ্ডব থেকে রক্ষা পাবে শত শত কোটি টাকার সহায়–সম্পদ।
রুকক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পওর) বিভাগের বদরখালী সাব ডিভিশনের উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) ঈমান আলী জানান, প্রকল্পটির সার সংক্ষেপ তুলে ধরে মন্ত্রণালয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। অর্থ ছাড় পেলে আগামী অর্থ বছর থেকে পর্যায়ক্রমে কাজ শুরু করা হবে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা (এস.ও) মো. তারেক বিন ছগির জানান, কক্সবাজার জেলার তিগ্রস্ত পোল্ডার সমূহের পূনর্বাসন (১ম সংশোধিত) প্রকল্পের আওতায় চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদীর হাজি পাড়ায় ৬০০ মিটার, কৈয়ারবিলে ৪০০ মিটার, বেতুয়া এলাকায় ১০০০ মিটার, সেকান্দর পাড়ায় ৫০০ মিটার ও আবদুল বারি পাড়ায় ৫০০ মিটারসহ সর্বমোট ৩ কিলোমিটার এলাকায় খাল খননের জন্য ৭ কোটি ৬১ লাখ ৮ হাজার ৯১০ টাকার প্রাক্কলন তৈরি করে দরপত্র আহ্বান করলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এস এস নেশান টেক (জেভি) ১০ শতাংশ কমদরে ৬ কোটি ৮৪ লাখ ৯৮ হাজার ১৯ টাকা দর উদ্বৃত করে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজটির কার্যাদেশ পান। পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ৬ ফেব্রুয়ারি ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এতে শর্ত দেওয়া হয় আগামী ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল কাজ সমাপ্তির দিন ধার্য্য করা হয়েছে।
রুঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নূরে বশির সয়লাব জানান, তারা ইতিমধ্যে হাজি পাড়া এলাকায় ৬০০ মিটার খাল খনন কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
এতে ইতোমধ্যে ৩০০ মিটারের মতো নদীর তলদেশ খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৩০০ মিটার খনন কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
রুপাউবো কর্মকর্তারা জানান, সিডিউল অনুযায়ী ৬০০ মিটার দৈর্ঘ্য, ৬০ মিটার প্রস্ত ও ১ থেকে ৩ মিটার গভীর করে এই খনন কাজ চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কাজের সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। আগাম ঝড়–বৃষ্টি না হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন হবে।
রুভুক্তভোগী মাতামুহুরী নদীতীরের বাসিন্দারা জানান, বান্দরবানের আলীকদম, লামা এবং কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ১৩৫ কিলোমিটার মাতামুহুরী নদী। এক সময়ে খরস্রোতা মাতামুহুরী নদীটি দীর্ঘদিন খনন কাজ না হওয়ায় বর্তমানে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর বিভিন্নস্থানে পলি মাটি ও বালিতে চর ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক গতিতে পানি প্রবাহিত হতে পারেনা। এতে বর্ষা মৌসুমে একাধিকবার ভয়াবহ বন্যায় নদীর দুই তীরের শত শত একর জমির ফসল ও স্থাপনা নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। এছাড়া অসংখ্য ঘরবাড়ী, হাটবাজার, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, কবরস্থান ও মন্দিরসহ সরকারী অর্থ ব্যয়ের নির্মিত রাস্তাঘাট, ব্রিজ–কালভার্ট ভেঙে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ওই চার উপজেলার সরকারী কর্মকর্তাদের প্রদত্ত রিপোর্ট অনুযায়ী গতবারের বন্যায় ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ। ঘরবাড়ি হারিয়েছে অসংখ্য পরিবার।
রুচকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ জাফর আলম বলেন, ‘মাতামুহুরী নদী একসময় আশীর্বাদ হলেও প্রতিবছর বর্ষায় এখানকার মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে আসছে। এমনকি এই নদী গত একশ বছরে একবারও খনন করা হয়নি। যার কারণে প্রতিবছর বর্ষায় সবকিছুই ছারখার করে দেয় রুদ্রমূর্তি ধারণকারী এই মাতামুহুরী।’
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবছর বর্ষায় মাতামুহুরী নদীর তাণ্ডবলীলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র জানতে পেরে মাতামুহুরী নদী খনন ও তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ৪২২ কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে চলতি অর্থ বছরের প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মাতামুহুরী নদীর ৬০০ মিটার এলাকায় খনন কাজ শুরু হয়েছে।
কক্সবাজার–১ আসনের এমপি আলহাজ্ব মৌলভী মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীর নিয়ে অনেক স্মৃতি বিজরিত ইতিহাস রয়েছে। গত সাড়ে চারবছরে উপকূল ও মাতামুহুরী নদীর তীর সংর ণের জন্য প্রতিরক্ষামূলক কাজের বিপরীতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ এনেছেন। ইতোমধ্যে পাইলট প্রকল্পের অধীনে প্রাথমিকভাবে সাত কোটি টাকা ব্যয়ে ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ খননকাজ শুরু হওয়ায় চকরিয়া ও পেকুয়ার মানুষ খুব খুশি।’
পাঠকের মতামত: