ঢাকা,সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

মসজিদে আজান ও নামাজ পড়তে দেয়া হচ্ছেনা রোহিঙ্গা মুসলমানদের

myanmerফরিদুল মোস্তফা খান, টেকনাফ থেকে ফিরে :
মসজিদে মাইকে আজান ও নামাজ পড়তে দেওয়া হচ্ছে না রোহিঙ্গা মুসলমানদের। শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে দেয়া হয়নি তাদের। ওই দিন দুপুরের পর থেকে পুনরায় অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসি।

গত ১০ অক্টোবর থেকে রাখাইন প্রদেশ রোহিঙ্গা মুসলিমশূন্য করতে এই নির্যাতন শুরু। স্থলবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছে হেলিকপ্টার গানশিপ। প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু জানা না গেলেও প্রত্যদর্শীরা প্রতিদিন দিচ্ছেন লোমহর্ষক বর্ণনা। তারা নারী ও শিশুদের গণধর্ষণ, নির্বিচারে হত্যা ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার বর্ণনা দেন।

রাখাইন প্রদেশে নজিরবিহীন নির্যাতনে শিকার অসংখ্য ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, ভীতসন্ত্রস্ত ও সম্ভ্রমহারা নারী প্রাণ বাঁচাতে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের লোনাপানিতে এই শীতে ভাসছেন।

এসব রোহিঙ্গা মুসলমান বলে কি মানুষ নয়? তারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে সাগরে ভাসতে থাকলেও কেন কোনো মানবতাবাদীর চেতনা জাগ্রত হয় না? কথায় কথায় যারা মানবতার কথা বলে মুখে ফেনা তোলেন, তারা আজ কোথায়? এ ধরনের প্রশ্ন এখন সীমান্তের সব শ্রেণীর মানুষের।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু থানার ছোট গজিরবিল গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী সমুদা খাতুন। টেকনাফের একটি গ্রামে আশ্রয় নেয়া এই বৃদ্ধার সাথে গতকাল শনিবার কথা হয়। তিনি জানান, ‘আমার ভাতিজিকে সেনাবাহিনী ধর্ষণ করেছে। অতিরিক্ত রক্তরণে মাঝপথে সে মারা যায়। সেনাবাহিনী এসে পড়ায় গোলপাতার বাগানে তাকে একটা কাপড় মুড়ে ফেলে রেখে আমরা কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে এসেছি। দুঃখ, ভাতিজির লাশটা দাফন করতে পারলাম না। আমার নিজের ছেলে ও ভাইপোকেও আমরা একই অবস্থায় ফেলে এসেছি। সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের ঘরে আবদ্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। কেউ পালাতে চাইলে গুলি করে অথবা জবাই করে। আমার আরো দুই আত্মীয়কে এক বাসায় রেখে এসেছিলাম। সকালে গিয়ে তাদের গলাকাটা লাশ পেয়েছি। হেলিকপ্টার দিয়ে আমাদের গ্রামে হামলা হয়েছিল। প্রায় দুই সপ্তাহ পর বাংলাদেশে পৌঁছতে সম হয়েছি।’

তিনি আরো জানান, ১৪ দিন আগে গৃহহারা আরো বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে এখন নিরাপদ আশ্রয়ে এসেছেন। তার বর্ণনায় উঠে আসে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতনের চিত্র।

মিয়ানমারের সৈন্যদের নির্মম নির্যাতনে দিশেহারা রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় ফিরতে হবে মৃত্যুপুরি মিয়ানমারের দিকে। তাই নাফ নদীতেই ভেসে ভেসে অপেক্ষা করছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।

মিয়ানারের গরজিল গ্রামের বাসিন্দা ছমিরা বেগম। তার স্বামীর নাম মোহাম্মদ আইয়ুব। তিনি জানান, একদিন সকালে হঠাৎ করে মিয়ানমার ‘সৈন্যরা এসে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তারা আমার স্বামীকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। এ সময় আমিসহ আমার আরো দুই ছোট বোনকে বাড়িতে বেঁধে রাখে। এরপর বাইরে চিৎকারের শব্দ শুনতে পান। কিছুণ পরে বের হয়ে দেখি তারা আমার স্বামীকে জবাই করেছে। তারা আমার দুই ছোট বোনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি বাধা দিলে আমাকে মারধর করে মাটিতে ফেলে দেয়। তিন ঘণ্টা পর আমার ছোট বোনদের বাড়িতে দিয়ে যায়। বোনদের কাছে জানতে চাইলে তারা কাঁদতে থাকে। পরে দুইজন চিৎকার করে বলে আমাদের গণধর্ষণ করেছে তারা।

মিয়ানমারের কোরিয়ারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নূর বাহার জানান, তার স্বামী দিলদার হোসেন একজন জেলে। মাছ শিকার করে তাদের সংসার চলে। তার চার ছেলেমেয়ে। মিয়ানমারের সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে তাকে বের করে দিয়ে তার স্বামীকে ঘরে আটকে রাখে। পরে সৈন্যরা বাইরে থেকে ঘরের চার পাশে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর কী আর বলব…? আগুন দিলে কেউ কি বেঁচে থাকে! তারা এইভাবে আমার স্বামীর মতো অনেককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এ অবস্থায় প্রাণের ভয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাফ নদী পার হয়ে একটি নৌকায় আমরা ২৫ জনের একটি দল বাংলাদেশে আসি।

শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গাদের প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশির নামে যেকোনো বাড়ি পুড়িয়ে দিতে দ্বিধা করছে না সৈন্যরা। বাড়ি থেকে কাউকে বের হতে দেখলেই গুলি চালায়। শুধু বাড়ি পুড়িয়েই ান্ত হচ্ছে না, বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার পর তাদের খোলা আকাশে বসিয়ে রাখছে তারা। এমন বর্ণনা দিলেন অপর আশ্রয় নেয়া কামাল হোসেন ও মো: মুজিবুল্লাহ। তারা মিয়ানমারের চালিয়াপাড়ার বাসিন্দা।

মুজিবুল্লাহ আরো জানান, আমার ছোট ভাই শফিউল আলম বাড়িতে ফেরার সময় সৈন্যরা রাস্তা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেখতে গেলে দেখিÑ রাস্তার পাশে ধােেনত আমার ভাইকে জবাই করে হত্যা করছে। আমি পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যাই। পৃথিবীতে খুবই খারাপ মানুষ থাকে জানি। কিন্তু মিয়ানমারের এরা কি মানুষ? এদের মানবতা বলতে কিছুই নেই?

এ দিকে টেকনাফ বিজিবি সূত্র জানায়, গভীর রাতে টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে চারটি বোটকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। বোটগুলোতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছিল।

এ দিকে কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে একজনকে প্রতিহত করে বিজিবি।

পাঠকের মতামত: