মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া ::
কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের লঞ্চঘাটের দক্ষিণ পাশে সাগরে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে উপকূলীয় বনবিভাগের মালিকানাধীন সংরক্ষিত বনভূমি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গার ওপর দিয়ে অবৈধভাবে সামুদ্রিক বালু তুলছেন প্রভাবশালীরা। বঙ্গোপসাগরের মগনামা-কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে প্রকাশ্যে বড় আকারের পাইপ লাইন বসিয়ে সাগর থেকে গত ১০-১৫ দিন ধরে অব্যাতভাবে বালু উত্তোলন করলেও রহস্যজনক কারণে নিরব রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ ও পাউবো।
তবে উপকূলীয় বন বিভাগের মগনামা বনবিট কর্মকর্তা হুসনি মোবারক জানান, পাইপ বসানোর সময় বাধা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বালু উত্তোলনে জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় বন বিভাগের নির্দেশ মানছে না। তিনি এ ব্যাপারে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করেছেন।সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, কক্সবাজারের সাগর উপকূলীয় দুই উপজেলা পেকুয়া ও কুতুবদিয়ার মধ্যবর্তী স্থান বঙ্গোপসাগরের মগনামা-কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে উজানটিয়া ইউনিয়নের আসিফ নামের এক ব্যক্তি।
তবে আসিফ বালু উত্তোলেনের বিষয়ে বলেন, তিনি ড্রেজার মেশিন ভাড়া দিয়েছেন। বালু উত্তোলেন করছেন বানৌজা সড়কের ঠিকাদার জামিল সাহেব নামের এক ব্যক্তি। তবে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, সাগর থেকে বালু উত্তোলনে আসিফের দেওয়া বক্তব্যের সাথে মিল পাওয়া যায়নি। বালু উত্তোলনে বানৌজা সড়কের ঠিকাদার জামিল সাহেব কোনভাবেই জড়িত নয়। উজানটিয়ার যুবক আসিফ মগনামার সাবেক এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্দনে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে জায়গা ভরাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বেচা-বিক্রি করছে।
স্থানীয় পরিবেশবাদী সচেতন মহল জানান, মগনামা-কুতুবদিয়া চ্যানেলের মগনামা লঞ্চঘাটের দক্ষিণ পার্শ্বে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখায় নষ্ট হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। এর ফলে ধ্বংস হচ্ছে বনজ সম্পদ, সামুদ্রিক খনিজসম্পদ, সামুদ্রিক প্রাকৃতিক জীবসম্পদ, মৎস্য, চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক, ডলফিন, কাঁকড়া, সি-উইড, সামুদ্রিক স্তণ্যপায়ী প্রাণী, বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজনন-আবাসস্থল। জলবায়ু ও জীববৈচিত্রের ইকো-সিস্টেমকে ক্ষতিসাধন করে রাষ্ট্রের সামুদ্রিক জলজ সম্পদের ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। এছাড়া সমুদ্রতল, জলরাশি, জলস্রোত, বায়ু, সামুদ্রিক প্রবাল প্রাচীরও দূষিত হচ্ছে।
মগনামার লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা মকছুদ জানান, মগনামার কতিপয় প্রভাবশালীরা সিন্ডিকেট করে নিয়মানীতির তোয়াক্কা না করেই বালু উত্তোলন করছেন। বালু উত্তোলন বন্ধে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকের সহায়তা কামনা করেছেন।
পেকুয়া সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার কাজল কান্তি শীল জানান, মগনামা লঞ্চঘাটের দক্ষিণ পার্শ্বে সাগরের মগনামা-কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে বালু উত্তোলনের জন্য কাউকে প্রশাসন অনুমতি দেয়নি।
জানা যায়, জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের ২৭৪৯ (২৫) নম্বর সিদ্ধান্ত এবং জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালের ৯ ডিসেম্বরের জ্যামাইকা কনভেশনে সাধারণ পরিষদের ১৫১৪ (১৫) নাম্বার সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের জীববৈচিত্র কনভেনশন ১৯৯২, ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত জৈব নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রটোকল ২০০০, ১৯৭৩ সালের সাইটাস, ১৯৮০ সালের আইইউসিএন বিশ্ব সংরক্ষণ কৌশল, ১৯৮২ সালের প্রকৃতির বিশ্ব সনদ, ১৯৭২ সালের স্টকহোম ঘোষণা, দীর্ঘস্থায়ী জৈব রাসায়নিক পদার্থ সংক্রান্ত স্টকহোম কনভেনশন ২০০১, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘ প্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ১৯৯২, রামসার কনভেনশন ১৯৭১-এ সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, সমুদ্রের ইকো-সিস্টেমের ক্ষতিসাধন করে কোনো ধরণের ড্রেজার বসিয়ে মাটি বা বালি উত্তোলন করা যাবে না। জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ও জ্যামাইকা কনভেনশনে বাংলাদেশ অন্যতম স্বাক্ষরকারী একটি দেশ।জাতীয় পরিবেশ নীতিমালা ১৯৯২-এর ৩ (১০) ধারা অনুযায়ী দেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক ইকো-সিস্টেম এবং সম্পদের পরিবেশসম্মত সংরক্ষণ, উন্নয়ন, দূষণরোধ করার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশোধনী ২০১০-এর ৬ (ঙ) ও ১৬ ধারা মোতাবেক সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করা সরাসরি নিষিদ্ধ থাকলেও আইনের তোয়াক্কা না করেই মগনামা লঞ্চঘাটের দক্ষিণ পাশে সাগরে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নির্বিচারে বালি উত্তোলন করছে প্রভাবশালীরা!
জানা গেছে, মৎস্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০-এর ২ ও ৩ ধারা, মৎস্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ বিধি ১৯৮৫-এর ৩ (১) (২) বিধির উপবিধি (১) এবং সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্র অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১ (খ) (ঘ), ২৪ (২) ক, খ, ২৬ (ক) (খ) (গ) (ঘ) ধারা অনুযায়ী, নদীর মোহনা, সমুদ্রের মৎস্য প্রজনন ও আবাসস্থল এলাকায় বালি উত্তোলন করে মৎস্যসহ জীবন্ত সামুদ্রিক সম্পদের ক্ষতিসাধন করা যাবে না। এরপরও মগনামা লঞ্চঘাটের পাশে শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন বসিয়ে সামুদ্রিক খনিজ বালি উত্তোলন করা হচ্ছে।
এছাড়াও বিগত ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, মগনামা-কুতুবদিয়া চ্যানেলের মগনামা লঞ্চঘাটের পাশে সাগর থেকে বালি উত্তোলনের সাথে জড়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাঠকের মতামত: