ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

ভয়াল ২৯ এপ্রিল উপকূলবাসীর কান্নার দিন এখনো ভাঙা বেড়িবাঁধ আতঙ্কে লাখো মানুষ

cms.somewhereinblog.netফরিদুল মোস্তাফা খান, কক্সবাজার থেকে :::
২৯ এপ্রিল উপকূল বাসির কান্নার দিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। প্রাণ হারায় হাজারো মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় গবাদি পশু ও ফসলের। ঝড়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলের প্রায় লাখো মানুষ। ২৬ বছর পরও ঘূর্ণিঝড়ের সেই ক্ষত এখনো রয়ে গেছে উপকূলে। ভাঙা বেড়িবাঁধ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কক্সবাজারের পেকুয়া উপেজলার লাখো মানুষ। প্রলয়ংকরী সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের পশ্চিমকুল গ্রামের দিলফুরুজ বেগমের মেয়ে রিনা আক্তার (১০)। তাঁর আরও আটজন স্বজনকে ঝড়ে হারিয়েছেন তিনি। ঝড়ের পর পেকুয়ার উপকূলীয় এলাকায় ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে ১৯৯৮ সালের বন্যায় ভেঙে যায় সেই বাঁধ। এরপর থেকেই চলছে জোড়াতালির সংস্কার। দিলফুরুজের ছোট্ট ঘরটি পশ্চিমকুল গ্রামের বেড়িবাঁধের পাশে। বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশ ভাঙা। বর্ষায় জোয়ারের সময় বেড়িবাঁধ উপচে মগনামা ইউনিয়নে এখনো পানি আছড়ে পড়ে। দিলফুরুজ বেগম (৫৮) বলেন, ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের সময় ৫০ ফুটের বেশি উঁচু সেই জলোচ্ছ্বাসে মগনামা ইউনিয়নের প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দিলফুরুজের প্রতিবেশী আবু তাহের (৫৬) বলেন, গত বছরের জলোচ্ছ্বাসে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে গ্রামের ৪৫টির বেশি বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় আসছে বর্ষায় আবারও সেসব ঘরবাড়ি বিলীন হতে পারে। মগনামা ইউনিয়নের চেপ্টাখালী নাশি থেকে কাকপাড়া পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটারের মতো বেড়িবাঁধের কয়েকটি ভাঙা অংশে দুটি এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। আবার চেপ্টাখালী নাশি থেকে মগনামা লঞ্চঘাট পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বাইরের অংশে (সাগরের দিকে) ইট-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ব্লক বসানো হচ্ছে। কিন্তু কাকপাড়া বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ ও পাশের শরৎঘোনা এলাকার বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশে কাজ শুরু হয়নি। কাকপাড়ার লবণচাষি মো. ছরওয়ার (৫০) বলেন, শীত মৌসুমে সাগর যখন শান্ত থাকে, তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ভাঙা বাঁধের সংস্কার করে না। বর্ষায় যখন সাগর উত্তাল হয়, তখন বাঁধের সংস্কার শুরু হয়। মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ বলেন, কাকপাড়া ও শরৎঘোনা—এ দুই পয়েন্টে এখনো ভাঙা বেড়িবাঁধের সংস্কারকাজ শুরু হয়নি। ইউনিয়নের অন্যান্য এলাকার বেড়িবাঁধেরও কাজ হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। তাও হচ্ছে বালুর বাঁধ। ভরা বর্ষায় উত্তাল জোয়ারের ধাক্কায় এসব নড়বড়ে বালুর বাঁধ বিলীন হতে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। তখন বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিপরীতে সরকারের শত কোটি টাকা পানিতে যাবে। মগনামার পাশের ইউনিয়ন উজানটিয়া। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রতি বর্ষায় কাকপাড়া বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে উজানটিয়ার ৩০ হাজার মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়।
পাউবো সূত্র জানায়, পেকুয়া উপজেলায় প্রায় ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে সংস্কারকাজ চলছে ২০ কিলোমিটারে। এ জন্য বরাদ্দ পাওয়া গেছে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ বলেন, গত ৩০ মার্চের মধ্যে বেড়িবাঁধের সংস্কারকাজ শেষ করার দাবি ছিল মানুষের। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি। পেকুয়ার দায়িত্বে থাকা পাউবোর কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন বলেন, সাগর উত্তাল হওয়ায় কাকপাড়া এলাকার ভাঙা বেড়িবাঁধের কাজ এখন শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কাকপাড়ায় ২ হাজার ৮০০ ফুটের রিং বাঁধের নির্মাণকাজ আগামী ২০ দিনের মধ্যে শেষ করা হবে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, জেলার পেকুয়া, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী উপজেলার উপকূলে ভাঙা বেড়িবাঁধ নিয়ে মানুষ সমস্যায় আছে। বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করতে পাউবোর কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।
সোনাদিয়ায় ইকো ট্যুরিজম করার মহা পরিকল্পনা
ফরিদুল মোস্তাফা খান, কক্সবাজার থেকে ২৮ এপ্রিল
মহেশখালীর ৯ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষিত সোনাদিয়া দ্বীপকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করেছে সরকার। সেখানকার ১৩ হাজার একর এলাকায় ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। গত বুধবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসন প্রতীকী মূল্যে বেজার অনুকূলে দীর্ঘ মেয়াদে জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। বৃহস্পতিবার নিজেদের অনুকূলে জমি নিবন্ধনের কাজও সেরে ফেলেছে বেজা। এদিকে সোনাদিয়া দ্বীপ যেহেতু প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষিত, তাই এ দ্বীপকে ইসিএ থেকে অবমুক্ত করতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বেজা। দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করেই সোনাদিয়ায় ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন বেজার কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সম্মতি পাওয়ার পর আমরা বেজার অনুকূলে ১৩ হাজার একর জমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেছি। সোনাদিয়া দ্বীপে বেজা পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখে ইকো ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তুলবে বলে জেনেছি। ’ ‘সোনাদিয়া দ্বীপ ইসিএভুক্ত এলাকা’—এ প্রসঙ্গ তুললে আলী হোসেন বলেন, লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ আর ডাহুকের কথা বলে দেশকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। জাপান সরকার তাদের দেশে পরিবেশকে ঠিক রেখেই উন্নয়ন করেছে। আমরাও এখানে পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখে উন্নয়ন করব। ’ বেজার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত সোনাদিয়া দ্বীপে ইকো ট্যুরিজম পার্কে বিনিয়োগ করতে দেশের বড় বড় বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। বাংলাদেশের একজন পর্যটক থাইল্যান্ডে গিয়ে যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, তার সবটাই থাকবে সোনাদিয়া দ্বীপে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত ও পরিচিত এমন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা সেখানে নেওয়ার আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে চিকিৎসার জন্য যাতে ভারতসহ অন্য কোনো দেশে না যেতে হয়, সে জন্য করা হবে আন্তর্জাতিকমানের হাসপাতাল। সোনাদিয়ায় এখন যেহেতু বিচ্ছিন্নভাবে শুঁটকি তৈরি করা হয়, সেটি আরো আধুনিক ও পরিবেশসম্মতভাবে করতে আলাদা একটি অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে। সোনাদিয়ায় কিভাবে রেল সংযোগ দেওয়া যায়, সে চিন্তাভাবনাও শুরু হয়েছে। বেজার কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারে নাফ ইকো ট্যুরিজম পার্ক, টেকনাফ পর্যটন এলাকার মতো সোনাদিয়া দ্বীপকেও একটি আদর্শ পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চান তাঁরা। সেখানকার অবকাঠামো উন্নয়নে এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু করেছে। এর আগে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের প্রতিযোগিতার কারণে ‘কাউকে অখুশি না করার’ নীতি নিয়ে সরকার সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। জানতে চাইলে এসডিজি বাস্তবায়নবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পরিবেশকে সুরক্ষা করতে আমরা সোনাদিয়া দ্বীপকে ইকো ট্যুরিজম পার্ক করার উদ্যোগ নিয়েছি, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে যেটা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ’ তিনি বলেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপে প্রচুর লাল কাঁকড়া আছে। আমরা সেগুলো রাখার ব্যবস্থা করব। সেখানে মানুষ যাতে যেতে পারে, সে জন্য যোগাযোগব্যবস্থা উন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ’ সমীক্ষার কাজ চলছে বলে জানান তিনি। সোনাদিয়া দ্বীপকে ইসিএ থেকে অবমুক্ত করতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য তৈরি করা চিঠিতে বেজা বলেছে, ‘পর্যটন শিল্পের জন্য জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কক্সবাজার জেলার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বেজা ইতিমধ্যে টেকনাফ উপজেলায় সাবরাং ও নাফ ট্যুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ করেছে। এবং পিপিপি মডেলে ওই পার্কের উন্নয়নের জন্য ডেভেলপার নিয়োগের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

পাঠকের মতামত: