ভয়াবহ পাহাড় ধস, পাহাড় কাটা, বৃক্ষ উজাড়ের পাশাপাশি এসব বৃক্ষের গোড়ালী পর্যন্ত উৎপাটন করে ফেলায় প্রতিবছর বন্যার সময় মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢলের পানি। এতে প্রমত্তা মাতামুহুরী নদী তার সেই চির যৌবনা হারিয়ে ব্যাপক নাব্যতা সংকটে পড়েছে। কিছুদূর অন্তর নদীর তলদেশ একেবারে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢল নামলেই তা দুইকূল উপচে এবং নদীর তীর ভেঙে তা লোকালয়ে প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষতি করছে। এই অবস্থায় ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে আগের সেই গতিপথ ফিরিয়ে দেওয়া চকরিয়ার প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর মাতামুহুরী নদীর তলদেশ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে এখানকার মানুষকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করার কথা বলে আসলেও কার্যত তা অদৃশ্যমান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪ সালের একাধিক ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সরজমিন পরিদর্শন করে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি মাতামুহুরী নদীর ড্রেজিংয়ে একটি মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির ইতিমধ্যে দুইবছর অতিবাহিত হতে চললেও কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি না দেখায় হতাশ এখানকার মানুষ।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার–১ (চকরিয়া–পেকুয়া) আসনের জাতীয় পার্টির (এরশাদ) এমপি মোহাম্মদ ইলিয়াছ গতকাল শনিবার দুপুরে চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘একযুগ আগেও মাতামুহুরী নদী চকরিয়া–পেকুয়াবাসীর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছে। এই নদীর মিঠাপানি ব্যবহার করে প্রতিবছর কৃষকেরা চাষাবাদ করে আসছে। কিন্তু অব্যবহিত এই সময়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে পাহাড় ধস, বৃক্ষ নিধনসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কারণে প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বিশেষ করে চকরিয়াবাসীর জন্য প্রতিবছর বর্ষায় অভিশাপে পরিণত হয়েছে।’
এমপি ইলিয়াছ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আমি এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৪ সালে একাধিক ভয়াবহ বন্যায় চকরিয়া ও পেকুয়ার ব্যাপক ক্ষতি হয় শুধুমাত্র নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে। সেইসময় আপ্রাণ চেষ্টায় পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সরজমিন পরিদর্শন করেন নৌ–যান নিয়ে। এ সময় তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন মাতামুহুরী নদীর চকরিয়া অংশের দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার ড্রেজিং করে নদীর আগের সেই গতিপথ ফিরিয়ে দেওয়ার। সেই আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড সমীক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে নদীতে। আশা করছি চলতি শুষ্ক মৌসুমে নদীর ড্রেজিংয়ের কাজ দৃশ্যমান হবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান দৈনিক চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘কয়েকমাস আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধতন কর্মকর্তাসহ ড্রেজিং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা সমীক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছেন। এর পর তার ডিজাইন আকারে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।’
এই কর্মকর্তা জানান, দুই কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথমদিকে দুই কিলোমিটার এলাকায় নদীর তলদেশ ড্রেজিং করা হবে। ওই এলাকার ড্রেজিং সফলভাবে সম্পন্ন হলে পরে একটি মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। এতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। সবিবুর রহমান বলেন, ‘আশা করছি চলতি শুষ্ক মৌসুমেই মাতামুহুরী নদীর তলদেশ ড্রেজিং কাজে হাত দেওয়া হবে। তার সঙ্গে নদীর দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নদীর উৎপত্তিস্থল (উজান) পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে গত কয়েক দশকে ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন ও বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের কারণে প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা পলি জমে বছরের পর বছর ১৬৫ কিলোমিটার আয়তনের মাতামুহুরী নদীর বেশির ভাগ স্থানে শতাধিক ডুবোচর জেগে উঠেছে। এ অবস্থার কারণে বর্তমানে ভয়াবহ নাব্যতা সংকটের মুখোমুখি হয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যের নিদর্শন এই নদী। শুধু তাই নয়, এভাবে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদীতে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় কারণে পানি চলাচলের স্বাভাবিক গতিও হারিয়েছে। এতে নতুন নতুন এলাকায় নদীর দুই তীরে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ জাফর আলম চকরিয়া নিউজকে বলেন, নাব্যতা সংকটের কারণে প্রতিবছর নদীর দুই তীরে ভাঙন ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। গত দুই দশকে ভাঙনের কবলে পড়ে অন্তত ১০ হাজার পরিবার ভিটেবাড়ি ও জায়গা–জমি হারিয়েছে। অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ভাঙনের ভয়াবহতা ঠেকাতে হলে নদীর চিরিঙ্গা মাতামুহুরী ব্রীজ পয়েন্ট থেকে শুরু করে উজানে মানিকপুর ও নীচে পালাকাটা রাবার ড্যাম পর্যন্ত এলাকায় ড্রেজিং করতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আরো বেশি নাব্যতা সংকটে পড়বে প্রমত্তা মাতামুহুরী নদী।’ চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো.আতিক উল্লাহ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছর মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানি আটকিয়ে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা এবং বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার কয়েক লাখ কৃষক সেচ সুবিধা নিয়ে ইরি–বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করে আসছে। তন্মধ্যে নদীর সেচ সুবিধা নিয়ে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় প্রতিবছর অন্তত ৭০ হাজার একর জমিতে আমন, বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করেন কৃষকরা।’ তিনি বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীর সেচ সুবিধা নিয়েই এখানকার কৃষকেরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। এখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য স্থানীয় ভোক্তাদের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানী হচ্ছে। এতে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে।’
তিনি দাবি করেন, বর্তমানে নদীতে একাধিক স্থানে ডুবোচর জেগে উঠায় কিছু কিছু এলাকায় সেচ সুবিধা নিতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী শাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে কৃষকরা আগের মতো মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানির সুফল পাবে। চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি এমআর মাহমুদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘উপজেলার সাড়ে ৫ লাখ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে মাতামুহুরী নদী। প্রতিবছর কৃষকরা নদীর সেচ সুবিধা নিয়ে চাষাবাদ করে শত কোটি টাকার ফসল উৎপাদন করছে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অর্জন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের আওতায় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নদীর দুই পয়েন্টে মাটির তৈরী অস্থায়ী ক্রসবাধ নির্মাণ করে পানি আটকিয়ে কৃষকরা সেচ সুবিধা নিত।’
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর দুই পয়েন্টে দুটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করে। এরপর থেকে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার কৃষকরা প্রতিবছর নিশ্চিন্তে নদীর মিঠাপানি আটকিয়ে জমিতে ফসল ফলাচ্ছেন। তবে নদীর এসব সুফল জনগণ ভোগ করলেও বর্তমানে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে ভাঙনের তাণ্ডব। মূলত প্রতিবছর বর্ষাকালে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সাথে পলি জমে নাব্যতা সংকটে পড়েছে মাতামুহুরী। এতে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে নদীর দুই তীর ভাঙনের কবলে পড়েছে। এই ভাঙন থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেনা জনবসতি ও আবাদি জমি। চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী ও সুরাজপুর–মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘একসময় মাতামুহুরী নদী আশীর্বাদ হলেও বর্তমানে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিবছর বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় নদীর দুই তীরে ভয়াবহ ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। আর ভাঙনের কবলে পড়ে শত শত পরিবার হারাচ্ছে বাপ–দাদার ভিটেবাড়ি ও আবাদি জমি। এতে মানুষ প্রায়ই নিঃস্ব হচ্ছে।’
তাঁরা আরো বলেন, মাতামুহুরীর উৎপত্তিস্থল বিশেষ করে লামা–আলীকদমে কয়েক দশকে পাহাড়ে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও পাথর আহরণের কারণে পলি জমে নদীটির সর্বনাশ হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নদীতে অবশ্যই ড্রেজিং করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
পাঠকের মতামত: