নিজস্ব প্রতিবেদক :: পাহাড় থেকে খাবারের খোঁজে লোকালয়ে এসে একের পর এক মারা পড়ছে বুনো হাতি। মৃত্যুর এই মিছিল যেন থামছেই না। সরকার কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বুনো হাতির মৃত্যুর তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশসচেতন কর্তাব্যক্তিরা। পাহাড়ি জনপদে বিচরণকারী হাতির সুরক্ষায় অভয়াশ্রম গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
স্থানীয় অধিবাসী ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় বুনো হাতির খাবারের উৎস দিন দিন কমছে। এ ছাড়া বনে মানুষের বাস ও আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় হাতির ‘হোমরেঞ্জ’ (নিজস্ব বিচরণক্ষেত্র) কমে গেছে। এ জন্য হাতি খাবারের খোঁজে লোকালয়ে নেমে আসছে।
খাবার খুঁজতে খুঁজতে পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে নেমে এসে মানুষের বাধার মুখে পড়ে হাতির দল। বাধা পেয়েই তারা ফসলের মাঠ, মানুষের বসতঘরে তাণ্ডব চালায়। একপর্যায়ে হাতির দল বুনো আচরণ শুরু করে। কোনো কোনো সময় পায়ে পিষ্ট করে, কখনো শুঁড় পেঁচিয়ে তুলে আছাড় দিয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। এই প্রেক্ষাপটে টিকে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের জান-মাল রক্ষায় বুনো হাতির ওপর হিংস্র হয়ে ওঠে মানুষ।
এদিকে দেশের বিভিন্ন সীমান্তের ওপার থেকেও অনেক বুনো হাতি গুলিবিদ্ধ হয়ে এপারে এসে মারা পড়ছে। ওপারে বনের জমিতে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদের কারণে কোনো কোনো সময় হাতিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার চোরা শিকারিরাও দাঁত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লোভে বন্য হাতিকে হত্যা করে। এপারে এলাকাবাসী ক্ষেতের ফসল রক্ষায় বৈদ্যুতিক ফাঁদ তৈরি করছে। সেই বিদ্যুতের পাতা ফাঁদে পড়ে হাতির মৃত্যু ঘটছে। দুর্ঘটনায়ও মরছে হাতি।
বুনো হাতির মৃত্যুর পরের কাহিনী প্রায় একই গল্পে তৈরি। হাতির মরদেহ উদ্ধারের পর সেটির সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে বন বিভাগ ও পুলিশ। থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। প্রাণিসম্পদ বিভাগ ময়নাতদন্তের জন্য ফুসফুস, পাকস্থলীসহ কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা যেতে পারে। ময়নতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।
বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী, বুনো হাতি হত্যা করলে দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। আর হাতির আক্রমণে নিহত হলে সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বন বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে এক লাখ টাকা এবং আহত হলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পেলেও বুনো হাতি হত্যার ঘটনায় সাজার কোনো তথ্য নেই।
সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের একাধিক সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ে বনের জমি জবরদখল করে অবৈধ বসতি স্থাপন করার কারণে বুনো হাতির আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। এতে পাহাড় ও বন ধ্বংসের পাশাপাশি হাতিসহ বন্য প্রাণীদের বিচরণক্ষেত্র ও চলাচলের পথ নষ্ট হচ্ছে। জবরদখলকারীরা বিভিন্নভাবে প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ায় তাদের উচ্ছেদও করা যাচ্ছে না। অবৈধ বসতি ও জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করা না গেলে এখানকার বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কঠিন হবে।
শেরপুর থেকে আমাদের প্রতিনিধি হাকিম বাবুল জানান, ৯০ দশক থেকে শেরপুরের সীমান্ত জনপদে বন্য হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বের শুরু। সাম্প্রতিক সময়ে এ দ্বন্দ্ব আরো গতি পেয়েছে। সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি জনপদে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসন ও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবু বুনো হাতির মৃত্যু দমানো যাচ্ছে না। বুনো হাতির জন্য শেরপুরে একটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলার জন্য ২০১৪ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি প্রস্তাবনা পাঠালে পরে সেটি গতি হারায়।
ময়মনসিংহ বন বিভাগ এবং শেরপুর বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যালয়ের হিসাব থেকে জানা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে এ বছরের ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ীর পাহাড়ি এলাকায় ২৯ বুনো হাতির মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৬ অক্টোবর শ্রীবরদীর রাঙাজান পাহাড়ের বাহাজের টিলা থেকে একটি মাদি হাতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর নালিতাবাড়ীর সীমান্তে হাতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
আইইউসিএনের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, শেরপুরের বনাঞ্চলে ১২০ থেকে ১২৫টি হাতির বিচরণ রয়েছে। এর সবই পারিযায়ী। এসব হাতিকে এশিয়ান হাতি বলা হয়। বর্তমানে এসব এশিয়ান হাতি খুবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভারত থেকে আসা এসব বন্য হাতি শেরপুরের সীমান্তবর্তী আট হাজার ৩৭৬ একরের বনভূমিতে বিচরণ করে। ধান ও কাঁঠালের মৌসুমে খাবারের খোঁজে প্রতি রাতে হাতিগুলো পাল বেঁধে চলে আসে সমতলে। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পর্যন্ত চষে বেড়ায়।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ইদানীং বুনো হাতির চলাচলের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আগে ২৫-৩০টি হাতি একত্রে দল বেঁধে চলাফেরা করত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, একটি-দুটি হাতি দলছুট হয়ে চলাফেরা করছে। এতে ঝুঁকি বাড়ছে।
শ্রীবরদীর খ্রিস্টানপাড়া গ্রামের ব্রতীন মারাক বলেন, ‘এক যুগ আগেও হাতি ছিল। এত হাতি মারা যায় নাই। আগেও আবাদ অইছে। হাতি মারার লাইগা জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে ফাঁদ পাতে নাই। অহন জেনারেটরের সঙ্গে জিআই তার দিয়ে হাতি মারার ফাঁদ পাতে। হাতি ফসলের ক্ষেতে আহনের আগেই বিদ্যুতের শর্ট খাইয়া মারা যায়। এইডারে কয় বিষক্রিয়ায় মারা গেছে।’
বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘হাতি রক্ষায় আমরা বনের ভেতর সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে দেশীয় জাতের বৃক্ষ রোপণ করছি। যাতে খাবারের অভাবে হাতি লোকালয়ে না আসে।’
কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে ছোটন কান্তি নাথ জানান, কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালীতে রয়েছে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছিল বুনো হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর নিরাপদ আবাস। কিন্তু গত ১০ বছরে এই আবাসস্থল ধ্বংসের অংশ হিসেবে গাছ কাটা, পাহাড় সাবাড় এবং সংরক্ষিত বন দখলে নিয়ে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে অবৈধ ইটভাটা, শত শত বাড়িঘর। ফলে বনের নিরাপদ আবাস হারিয়ে হাতির পাল ঘন ঘন নেমে আসছে লোকালয়ে।
পরিবেশবাদী সংগঠন, বন বিভাগসহ স্থানীয় পরিবেশসচেতন মহলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বন্য প্রাণী তথা বুনো হাতির আবাসস্থল একেবারেই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের উচিতার বিল মৌজায়। বান্দরবানের লামা এবং কক্সবাজারের চকরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় এই মৌজার অবস্থান। এখানেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আবাস ছিল বুনো হাতির। কিন্তু সেখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী গড়ে তোলেন অবৈধ ইটভাটা। মূলত উচিতার বিলের এই অভয়ারণ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত খাবারের খোঁজে হাতির দল নেমে আসা শুরু করে লোকালয়ে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘উচিতার বিল মৌজার বুনো হাতির আবাসস্থল আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। যাতে হাতি নিরাপদে সেখানে বিচরণ করতে পারে। এটি একমাত্র সম্ভব হবে সেখানে অবৈধভাবে গড়ে তোলা ইটভাটাটি ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে।’
তবে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ফাঁসিয়াখালী ও ডুলাহাজারা বনবিটের বন্য প্রাণীর আবাসস্থল সেই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মো. ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, ধ্বংস হয়ে যাওয়া বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য আগেকার অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে উজ্জ্বল বিশ্বাস জানান, এশিয়ার একমাত্র হাতির প্রজননকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত চুনতি অভয়ারণ্য। আর এ চুনতি অভয়ারণ্য ঘিরে বাঁশখালীর বনাঞ্চল। তবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এরই মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে ১৫ হাজার অবৈধ ঘরবাড়ি। এসব বনে নির্মিত হয়েছে ছয়টি ইটভাটা। বনে ইটভাটার ধোঁয়া আর ঘরবাড়ির কারণে জীবজন্তু, পশুপাখি খাদ্য সংকটে বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। গত ছয় বছরে বাঁশখালীর বনাঞ্চলে মারা গেছে ১৩টি হাতি। অসুস্থ হয়ে পড়া তিনটি হাতিকে সুস্থ করে বনাঞ্চলে ছেড়েও দেওয়া হয়।
পাঠকের মতামত: