ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভাতিজার পরিবর্তে ভাড়ায় কারাভোগে চাচা

আজিম নিহাদ, কক্সবাজার :: এটি যেন এক আয়নাবাজির গল্প। আয়নাবাজি সিনেমায় যেমন প্রকৃত আসামীর পরিবর্তে ছদ্মবেশ ধারণ করে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীকে ভাড়ায় কারাভোগ করতে দেখা যায়, ঠিক সেরকমই একটি বাস্তব ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারে। প্রকৃত আসামীর পরিবর্তে কারাভোগ করছেন আরেক ব্যক্তি। তবে আয়বাজি সিনেমায় ভাড়ায় কারাভোগ করা অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর চরিত্রকে ‘প্রফেশনাল’ হিসেবে দেখা গেলেও কক্সবাজারের ঘটনায় অনেকটা কৌশলে ফাঁসানো হয়েছে কারাভোগ করা ব্যক্তিকে।
কিন্তু কক্সবাজারের গল্পটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তৎপরতায় ফাঁস হয়ে গেছে ভাড়ায় কারাভোগ করানোর গল্প। ধরা পড়েছে আসল অপরাধী।
কক্সবাজারে আয়বাজি সিনেমার মতো ভয়ংকর অপরাধের আন্দোপ্যান্ত বলেছেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মাসুম খান ও পরিদর্শক মানস বড়–য়া।
ঘটনার শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে রামু থানা পুলিশ অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করেন সদর উপজেলার জালালাবাদ বাহারছড়া গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে মো. মোস্তাক আহমদকে। ওই বছরই জামিনে বের হন তিনি। পরে ২০০১ সালে ওমরা ভিসায় সৌদি আরব পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে সেখানে থেকে যান। এরইমধ্যে ২০১০ সালে জেলা ও দায়রা জজ আদালত অস্ত্র মামলায় মোস্তাক আহমদের ১৭ বছরের সাজা ঘোষণা করেন। কিন্তু ওই সময় তিনি ছিলেন সৌদিতে।
এদিকে টানা ১৯ বছর অবৈধভাবে সৌদিতে থাকার পর গত তিন মাস আগে বাংলাদেশে ফিরেন অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী মোস্তাক আহমদ। দেশে ফিরে দুরন্ধর মোস্তাক এক অভিনব ফন্দি আটেন। ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার আদলে কারাভোগের হাত থেকে পার পাওয়ার গল্প সাজান। অবশেষে গল্প সাজিয়ে ফাঁসিয়ে দেন আপন চাচা আমান উল্লাকে (৬৫)।
আমান উল্লাহ’র পরিবারের দাবী, তিনি সহজ-সরল একজন ব্যক্তি। ভাতিজার খপ্পরে পড়ে নিজেকে মোস্তাক আহমদ পরিচয় দিয়ে আদালতে হাজির হয়েছিলেন।
পরিবারের দেয়া তথ্যমতে, গত ১ ডিসেম্বর থেকে হঠাৎ খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলনা আমান উল্লাহ’র। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এবং বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করার পরও খোঁজ না পেয়ে পরিবারে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করে। পরে তারা জানতে পারেন, আমান উল্লাহ কারাগারে রয়েছেন। এরপর আমান উল্লাহ’র কারাভোগের আসল গল্প বের করতে ডিবি পুলিশের স্মরণাপন্ন হন তারা। বিষয়টি নিয়ে আমান উল্লাহ’র মেয়ের জামাই হোসাইন মোহাম্মদ কাইফু লিখিত অভিযোগ করেন ডিবি পুলিশের কাছে।
ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মানস বড়–য়া জানান, পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর আসল ঘটনা বের করতে অভিযান শুরু হয়। এক পর্যায়ে (সোমবার) ১৬ ডিসেম্বর রাতে শহরের কলাতলীর আদর্শগ্রাম এলাকা থেকে অস্ত্র মামলার সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামী মোস্তাক আহমদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়।
মানস বড়–য়া বলেন, আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আদালতের সাথে প্রতারণার কথা স্বীকার করেন মোস্তাক আহমদ। প্রথমত, দীর্ঘদিন অস্ত্র মামলায় পালিয়ে ছিলেন তিনি। এরপর দেশে এসে একজনকে ভাড়া করে নিজের পরিবর্তে কারাভোগে পাঠান।
ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মাসুম খান বলেন, আপন চাচা আমান উল্লাহ সহজ-সরল হওয়ায় তাকে টার্গেট করেন প্রতারক মোস্তাক আহমদ। পরে তাকে (আমান উল্লাহ) ৫০ হাজার টাকার প্রলোভন দেখিয়ে এবং অনেক আকুতি-মিনতি করে নিজের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পনে পাঠান। কিন্তু আদালতে উপস্থিত হওয়ার আগমুহুর্ত পর্যন্ত আমান উল্লাহ জানতেন না তাকে অস্ত্র মামলায় আত্মসমর্পনে পাঠানো হচ্ছে। তাকে (আমান উল্লাহ) বলা হয়েছিল অনেক দিনের পুরনো মারামারির ঘটনার একটি মামলা রয়েছে তার (মোস্তাক আহমদ) বিরুদ্ধে। কিছু অসুবিধার কারণে তিনি সরাসরি আদালতে যেতে পারছেন না। তিনি (মোস্তাক আহমদ) সেজে আদালতে হাজির হলেই আদালত জামিন দিয়ে দিবে। বিষয়টি আদালত টেরও পাবে না। বিনিময়ে তাকে (আমান উল্লাহ) ৫০ হাজার টাকা দিবেন তিনি।
মাসুম খান বলেন, পড়াশোনা না জানা আমান উল্লাহ আদালতে ঠিকই মোস্তাক আহমদের শেখানো মতে নিজেকে মোস্তাক আহমদ দাবী করেন। এরপর আদালত তাকে ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত অস্ত্র মামলায় কারাগারে প্রেরণ করেন।
ডিবি পুলিশ কর্মকর্তা মাসুম খান বলেন, পরিবারের দ্রুত অভিযোগ পাওয়াতে প্রতারক মোস্তাক আহমদের অপতৎপরতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। এখন জেলা ও দায়রা জজ আদালত বরাবরে প্রকৃত ঘটনার বিষয়ে দরখাস্ত করা হবে। আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবে।

পাঠকের মতামত: