নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়ায় বনবিট কার্যালয়ের নাকের ডগায় সংরক্ষিত বনভূমি দখলের পর সেখানে মাটি ভরাট করে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ কাজের প্রস্তুতি চলছে। গত ১৫ দিন ধরে বনভূমি দখলবাজির এই ঘটনা প্রকাশ্যে চললেও বনবিভাগের কর্মকর্তারা রহস্যজনক কারণে নীরবতা পালন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের হাসেরদীঘি থেকে পূর্ব দিকে লামা-আলীকদম সড়কের চকরিয়ার রিংভং অংশে ফাঁসিয়াখালী বনবিট সংলগ্ন এই দখলবাজির ঘটনা চলছে।
অবশ্য স্থানীয়দের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাহাত উজ-জামানের নির্দেশে কয়েকদিন আগে বনবিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও এখনো পর্যন্ত দখলবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উপরন্তু বনবিভাগের কর্মকর্তারা দখলবাজের পক্ষ নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। নিজের চোখের সামনে সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে ফেলা নিয়ে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন হাসেরদীঘির বাসিন্দা মো. রুহুল কাদের।
তিনি অভিযোগ করেন, ফাঁসিয়াখালীর রিংভং এলাকায় চকরিয়া-লামা-আলীকদম সড়কের পাশে এবং ফাঁসিয়াখালী বনবিট কার্যালয়ের একেবারে নিকটে সংরক্ষিত বনভূমির বিশাল এলাকা জবর-দখলে নিয়ে সেখানে এক্সেভেটর দিয়ে মাটি কাটা, অন্য স্থান থেকে বালু এনে অপেক্ষাকৃত নিচু বনভূমি ভরাট করার কাজ চলমান রয়েছে। এতে আশপাশের এলাকার পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করলেও দখলবাজদের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে দখলবাজরা আরো বেপরোয়া হয়ে সংরক্ষিত বনভূমি জবর-দখলের পর সেখানে স্থায়ীভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জোর প্রস্তুতি চালাচ্ছে।
রুহুল কাদের অভিযোগ করেন, ফাঁসিয়াখালী বনবিট কার্যালয়ের নাকের ডগাতেই এই দখলবাজি চলছে। গত ১৫ দিন ধরে এক নাগাড়ে সংরক্ষিত বনভূমি দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাইরাখালী এলাকার মৃত সোলতান আহমদের দুই ছেলে নেজাম উদ্দিন ড্রাইভার ও জয়নাল আবেদীন। জয়নাল আবেদীন স্থানীয়ভাবে বন জাইগীরদার (বন বিভাগের স্থানীয় সহযোগী পাহারাদলের সদস্য) হিসেবে নিযুক্ত। এই পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে জয়নাল ও তার ভাই নেজাম সংরক্ষিত বনভূমি দখলকর্মে লিপ্ত হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, বন, বনের গাছপালাসহ পরিবেশ-প্রতিবেশ পাহারায় বন বিভাগ এনজিও সংস্থার অধীনে বেশকিছু পাহারাদার নিয়োগ করে থাকেন। ফাঁসিয়াখালী ও মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে এরকম শতাধিক সদস্য। তাদেরকে বনবিভাগ ও নির্দিষ্ট এনজিও সংস্থার লোগোসহ পোশাকও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাদের কাজ হল বনবিভাগের কর্মচারীদের পাশাপাশি বন পাহারা দেওয়া।
এজন্য সংস্থার পক্ষ থেকে তাদেরকে নির্দিষ্ট ভাতাও প্রদান করা হয়। কিন্তু এসব সদস্যের অনেকেই বনভূমি উজাড়, বনভূমি জবর-দখলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। বিপরীতে বনবিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারাও তাদের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ফাঁসিয়াখালী ও মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান পাহারায় কাজ করা এনজিও সংস্থা নেকম-ক্রেল প্রকল্পের কর্মকর্তা মো. আবদুল কাইয়ুম বলেন, আমাদের সংস্থার ভাতাভোগী কোনো সিপিজি সদস্য যদি বন রক্ষার বদলে বনভূমি জবর-দখলসহ অবৈধ কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি বনবিভাগকেও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিতভাবে জানানো হবে।
সরজমিন বনভূমি দখলের ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর যোগাযোগ করা হয় ফাঁসিয়াখালী বনবিট কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি দৈনিক চকরিয়া নিউজকে বলেন, আমি এই বিটে যোগদান করেছি মাত্র তিনমাস। তাই দখলে নেওয়া জায়গাটি সংরক্ষিত বনভূমি কী-না তা নিশ্চিত নই।
তবে এসি ল্যান্ড ও রেঞ্জ কর্মকর্তা স্যারের নির্দেশনা পেয়ে তাৎক্ষণিক অকুস্থলে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দিই। এ সময় নির্দেশ দিলে মাটি কাটায় ব্যবহৃত এক্সেভেটরটি সরিয়ে নেওয়া হয়। বিট কর্মকর্তা কামরুল বলেন, ট্রেসম্যাপ দেখে পরিমাপের পর যদি জায়গাটি বনভূমির হয়ে থাকে তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেখানে কোনো সিপিজি সদস্য জড়িত থাকলেও তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান দৈনিক চকরিয়া নিউজকে বলেন, এক ইঞ্চি বনভূমিও কাউকে দখল করতে দেওয়া হবে না। যারাই এই অপকর্মে লিপ্ত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ফাঁসিয়াখালী বিট কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সরেজমিন বনভূমি দখলস্থল আমি নিজেও পরিদর্শন করেছি।
বনভূমি দখলে অভিযুক্তরা দাবি করেছেন, তারা কোনো বনভূমি দখলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। যে জায়গাটি এক্সেভেটর দিয়ে কাটা হয়েছে এবং ভরাট করা হচ্ছে সেটি তাদের খতিয়ানভুক্ত জায়গা। তবে সেই দাবি একেবারেই ভুয়া বলে নিশ্চিত করেছে বনবিভাগ ও আশপাশের বাসিন্দারা।
পাঠকের মতামত: