স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে দেখে সরকারী খাল-বিল জবর দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে প্রভাবশালীরা। প্যারাবনের (ম্যানগ্রোভ) ১৫ হাজার গাছ কেটে শহরের কস্তুরাঘাট স্থানে দখল করা হয়েছে কয়েকশ’ একর জলাভূমি।
সূত্র জানায়, প্রভাবশালীদের কালো থাবায় শহরের বাঁকখালী নদীর তীরে সৃষ্ট প্যারাবন কেটে গাছপালা উজাড় হওয়ায় ধ্বংস হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য। রাতারাতি সারিবদ্ধ মিনি ট্রাক ভর্তি মাটি এনে ভরাট করা হচ্ছে গাছের স্ট্যাম্পগুলো। কাটা গাছের গোড়ালি যাতে প্রশাসনের কেউ দেখতে না পান এ জন্য কৌশল হাতে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। কয়েক দিন ধরে প্যারাবনের বিশাল ভূমি টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখে সেখানে ভরাটের কার্যক্রম চালানো হলেও বাধা দেয়ার যেন কেউ নেই। ঐতিহ্যবাহী এই বাঁকখালী নদীর দখলদারদের উচ্ছেদ, দখল বন্ধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও তারা মানছেনা উচ্চ আদালতের এই আদেশ। প্রকাশ্যে প্যারাবনের গাছপালা উজাড় করে বালু ফেলে ভরাট করেই চলেছে। পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মোঃ নাজমুল হুদা বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছ কেটে প্যারাবন দখল ও ভরাটের সত্যতা পাওয়া গেছে। দখলদারদের তালিকা হচ্ছে, এরপর মামলা করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।
মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাটের বদরমোকাম জামে মসজিদসংলগ্ন পয়েন্টে দেখা গেছে, উজাড় করা বনভূমিতে (জলাশয়) ট্রাকে করে আনা মাটি ও বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চালানো হচ্ছে প্রভাবশালীদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ। দখলদারদের কেউ কেউ প্যারাবনের জমিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি উল্লেখ করে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। প্রতিবাদকারীদের মনোবল দুর্বল করতে ওই প্রভাবশালীরা বাঁকখালী নদীর ভরাট হওয়া জায়গাকে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি বলে দাবি করে টাঙ্গিয়েছে ওই সাইনবোর্ড। প্রশাসনকে ভুল তথ্য দেয়ার কৌশল হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে ওই সাইনবোর্ডটি।
বনভূমির একাংশে স্থাপনা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আমির আলী নামের একজন। তিনি বলেন, এখানে (প্যারাবনে) কয়েকশ’ একর জমি অন্তত ২০০ লোক কিনে নিয়েছেন। তিনি কিনেছেন ১৪ শতক জমি। তবে তিনি প্যারাবনের গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত নন। কিছু শ্রমিক রাতের বেলায় গাছগুলো কেটে নিতে দেখেছেন তিনি। ম্যানগ্রোভ ধ্বংসকারীদের তিনি চিনলেও নাম বলতে সাহস করেননি। নুরুল ইসলাম নামে আরেকজন টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছেন বিশাল এলাকা। নুরুল বলেন, এখানে কয়েকজনের জমি আছে। সব জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। কিন্তু জমির বিক্রেতার নাম, জমি কেনার রেজিস্ট্রি দলিল দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন এই দখলকারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দখলদাররা বলেন, স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি শ্রমিক দিয়ে রাতে হাজার হাজার কেউড়া, বাইনগাছ কেটে বনভূমি টিন দিয়ে ঘিরে দখলে নিচ্ছেন। এরপর প্রতি গন্ডা (দুই শতক) জমি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায় বিভিন্ন লোকজনের কাছে বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহেশখালীর রুকন, আমির আলী, কক্সবাজার শহরের রুমালিয়ারছড়ার নুরুল ইসলাম, কামাল মাঝি, শিবলু, কফিল, সানাউল্লাহ, আলম, ইব্রাহিম, ইউসুফ, মালেক, সাইফুলসহ অন্তত ২০ থেকে ২৫ ব্যক্তি দখলের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কক্সবাজার পরিবেশবাদীরা বলেন, কয়েক বছর আগে জাপানী একটি পরিবেশবাদী সংস্থার কর্মীরা জোয়ারের প্লাবন থেকে শহরবাসীকে রক্ষার জন্য বাঁকখালী নদীর তীরে কয়েক হাজার বাইন ও কেউড়া গাছের চারা রোপণ করেছিলেন। সেগুলো ২০ থেকে ২৫ ফুট উচ্চতার হয়েছে। এখন সেসব গাছ কেটে জলাভূমি দখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা।
সরেজমিনে দখল তৎপরতা দেখে পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপল-এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্যারাবনের অন্তত ১৫ হাজার গাছ কেটে নেয়ার চিত্র দেখতে পান তিনি। শুধু গাছ কাটাই নয়, সেখানে প্রকাশ্যে নদী দখল, ভরাট ও দূষণ করা হচ্ছে। মৌখিক ও লিখিতভাবে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অভিযোগ দেয়া হলেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে পরিবেশ অধিদফতরকে সঙ্গে নিয়ে দখলদারদের উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নু এমং মারমা।
পাঠকের মতামত: