নিজস্ব প্রতিনিধি, পেকুয়া ::
পেকুয়ায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি অপহরণকারী চক্র। গত কয়েক মাসে পরপর ৩টি অপহরণের ঘটনায় এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে একের পর অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় করার মাধ্যমে অপহরণকারীরা তাদের অবস্থান জানান দিলেও ওই চক্রের কোন সদস্যকে এখনো পর্যন্ত ধরতে পারেনি পুলিশ। ভুক্তভোগিদের অভিযোগ, এসব অপহরণের ঘটনার পেছনে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী জড়িত থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে না। তাছাড়া অপহরণের ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশর এক ধরনের অনীহাও রয়েছে বলে জানান তারা।
সম্প্রতি পেকুয়ায় একটি অপহরণের ঘটনায় বিকাশের টাকা উত্তোলনের সময় হাতেনাতে চকরিয়ার বেতুয়া বাজার থেকে আটক সেলিম উদ্দিন নামের অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে জিজ্ঞাসবাদে অপহরণের বিষয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এসময় অপহরণকারী চক্রে পেকুয়া উপজেলার একজন ইউপি চেয়ারম্যানও জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন গুম থেকে ফিরে আসা পেকুয়া বাজারের ব্যবসায়ী হারুণ।
এদিকে অপহৃত ব্যক্তির পরিবারের অভিযোগ, অপহরণের ঘটনা ঘটলেও থানায় অপহরণের মামলা নিতে গড়িমসি করে পুলিশ। কেননা ‘অপহরণ মামলা’ থানার জন্য ‘ডিসক্রেটিড’ বলে মনে করেন তারা। তাছাড়া পেকুয়ায় কোন ব্যক্তি পেকুয়া থেকে অপহৃত হয়ে চকরিয়ায় তাকে পাওয়া গেলে এ নিয়েও টানাটানি চলে দুই থানার মধ্যে। ভুক্তভোগিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেকুয়া থেকে অপহরণ করে চকরিয়ার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর মোবাইল ট্রেকিং এ অপহরণকারীদের অবস্থান চকরিয়ায় দেখা গেলে পেকুয়া থানা মামলা না নিয়ে চকরিয়া থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। আর ভুক্তভোগিরা চকরিয়া থানায় যোগাযোগ করলে পেকুয়ার বিষয় পেকুয়া থানায় মামলা না নেয়ায় তারাও মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। এভাবে সময় ক্ষেপণ করতে করতেই অপহরণকারীরা তাদের টার্গেট পূরণ করে অপহৃত ব্যক্তিকে ছেড়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অপহৃতদের স্বজনরা।
সর্বশেষ গেল বছরের ২৮ ডিসেম্বর পেকুয়া আলহাজ্ব কবির আহমদ চৌধুরী বাজারের চাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হারুণ (২২) ও মোবাইল ব্যবসায়ী নোমানকে অপহরণ করে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। অপহৃত ব্যবসায়ীর মোহাম্মদ হারুণ পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের আন্নর আলী পাড়ার মোস্তাক আহমদের পুত্র এবং মোবাইল সার্ভিসিং ব্যবসায়ী নোমানুল হক সদর ইউনিয়নের ভোলাইয়্যাঘোনা এলাকার মোহাম্মদ নুরুর ছেলে। এ ঘটনায় বিকাশের টাকা উত্তোলন করার সময় কৌশলে অপহরণকারী চক্রের সদস্য সেলিম উদ্দিনকে চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের বেতুয়া বাজার এলাকা থেকে হাতেনাতে আটক করে থানাপুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে ভিকটিমের স্বজনেরা। আটক সেলিম উদ্দিনের বাড়ি পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের নয়াকাটা এলাকায় বলে জানা গেছে। অপহৃত ব্যবসায়ীর স্বজনরা জানান, অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে আটক করে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিলে নড়েচড়ে বসে পুলিশ। পরে পুলিশের তৎপরতা বেড়ে গেলে ঘটনার পরদিন শুক্রবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে চকরিয়া উপজেলার আজিজনগর এলাকায় পাহাড়ি এক রাস্তায় ব্যবসায়ী হারুণকে ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য পথ দেখিয়ে দেয় অপহরণকারীরা। কিন্তু এর আগেই তার স্বজনদের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। এ ঘটনায় পেকুয়া থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেছে ভিকটিম হারুণের ভাই বেলাল উদ্দিন। মামলার বাদী বেলাল উদ্দিন জানান, তার ছোট ভাই হারুন পেকুয়া বাজারস্থ তার চালের দোকান ‘মেসার্স বেলাল স্টোর’টি দেখভালের দায়িত্বে ছিল।
ঘটনার দিন তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে চৌমুহনী এলাকায় গেলে সেখান থেকে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় একটি চক্র। পরে হারুণের মোবাইল থেকে ফোন করেই তাদের কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে হারুনকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়। উদ্ধার হবার পর অপহৃত হারুণ অপহরণের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন এ প্রতিবেদকের কাছে। জানান, ঘটনার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমি চৌমুহনী অবস্থানকালে আমার মোবাইলে বন্ধু পরিচয় দিয়ে একটি কল আসে। পরে কথিত ওই বন্ধুর সাথে দেখা করতে চকরিয়া–পেকুয়া সড়কের আনোয়ারুল উলুম মাদ্রাসার মোড়ে গেলে আমাদেরকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একটি নোহা গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। পরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দীর্ঘ পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটানোর পর একটি ঘরে হাত পা বেঁধে শারীরিক নির্যাতন চালায় তাদের উপর। এ সময় তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অপহরণকারীদের নির্দেশমতে তার এক জেঠাত ভাইয়ের কাছে ফোন করে বিকাশের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা পাঠানোর জন্য বলে। এসময় তার স্বজনরা প্রায় ৭ টি পার্সোনাল বিকাশ নাম্বারে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পাঠায়। পরে মামলার বাদী স্থানীয় ইউপি মেম্বারের পরামর্শে টাকা দেয়ার জন্য অপহরণকারীদের কাছ থেকে একটি এজেন্ট নাম্বার চাইলে তারা একটি এজেন্ট নাম্বার সরবরাহ করে। অপহৃত ব্যবসায়ী হারুণের স্বজনরা কৌশলে ওই এজেন্ট নাম্বারের মালিকের সাথে যাগাযোগ করে চকরিয়া থানা পুলিশের সহায়তা নিয়ে অপহরণকারীদের ধরতে ফাঁদ পাতে। এসময় একটি সিএনজি নিয়ে ৩ ব্যক্তি টাকা তুলতে এলে তাদের এক ব্যক্তিকে হাতেনাতে ধরতে পারলেও অপর দুই ব্যক্তি পালিয়ে যায় বলে জানান মামলার বাদী বেলাল উদ্দিন। অপহৃত হারুণ জানান, আমাদেরকে যখন হাত পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হচ্ছে তখন তাদের এক মোবাইল কথোপকথনে জানতে পারলাম পেকুয়ার একজন চেয়ারম্যান তাদের সেল্টার দিচ্ছেন। ছাড়া পাওয়ার পরে শুনলাম, এএসপি মতিউর আটক সেলিমের মাধ্যমে আমাকে বের করে দিতে ওই চেয়ারম্যানকে দিয়ে কৌশলে ফোন করান।
সূত্র জানায়, গত ৪ ডিসেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের গ্রামের বাড়ি কেয়ারটেকার আবদুর রশিদের স্কুল পড়ুয়া ছেলে পেকুয়া থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ওই একই চক্র। দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা পর আহত অবস্থায় চকরিয়া থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। অপহৃত স্কুল ছাত্র মাঈনুদ্দীন (১৬) উদ্ধার হবার পর যে বর্ণণা দেন তাতে দুটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা মাঈনুদ্দীনকেও বিএমচর ইউনিয়নের বেতুয়া বাজার থেকে অপহরণ করা হয় এবং পরে সেখান থেকেই উদ্ধার হয় সে। ধারণা করা হচ্ছে, চকরিয়া উপজেলার বিএমচর কেন্দ্রিক ওই অপহরণকারী চক্রের সাথে আঁতাত রয়েছে পেকুয়ার একটি চক্রের এবং কথিত ওই চেয়ারম্যান তাদের শেল্টার দিয়ে থাকেন। তাছাড়া আটক অপহরণকারী সেলিম উদ্দিনের বিরুদ্ধেও পাওয়া যাচ্ছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। পেশায় একজন ডাকাত সেলিম উদ্দিনের আলিশান নতুন বাড়ি তৈরি নিয়েও স্থানীয়দের মাঝে রয়েছে অনেক কানাগুশা। রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া সেলিম উদ্দিনের সম্পদের উৎস খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। তবে তাকে আটকের পর কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে এলাকায়। এলাকার লোকজন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পেকুয়ার অব্যাহত অপহরণ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি জানান।
পেকুয়া জিএমসি ইনস্টিটিউশনের ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী অপহৃত মাঈনুদ্দীন জানান, আমাকে একটি বেগুণ ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে নিয়ে একটি ঘরে আটকে রেখে ব্যাপক মারধর করে। এক পর্যায়ে তাদের নির্দেশে আমার মোবাইল থেকেই আমার বাবার কাছে ফোন দিয়ে বিকাশে টাকা পাঠাতে বলি। সে জানায় আমার বাবা একজন দিনমজুর। রাতে আমাকে বাঁচাতে কার কাছ থেকে যেন সুদের বিনিময়ে টাকা নিয়ে অপহরণকারীদের দেয়া মোবাইল নাম্বারে ১৫ হাজার টাকা পাঠায়। এ ব্যাপারে প্রথমে পেকুয়া থানায় এবং পরে চকরিয়া থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ অপহরণ মামলা না নিয়ে একটি সাধারণ ধারায় মামলা নেয়। ভিকটিম মাঈনুদ্দীনের পিতা কেয়ারটেকার আবদুর রশিদ জানান, ‘আমি এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে পুলিশের কাছে আমার ছেলে অপহৃত হলে তার মোবাইল এবং টাকা দেয়ার বিকাশ নাম্বার ট্রেকিং করে যাবতীয় কাগজপত্র পুলিশের কাছে দিয়েছি কিন্তু এরপরও অপহরণ মামলা করতে গেলে আমাকে বকা দেন চকরিয়ার ওসি।’
এদিকে বারবাকিয়া ইউনিয়নের নয়াকাটা এলাকার মৃত মনজুর আলমের পুত্র ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি সাইফুল ইসলাম একইভাবে অপহৃত হয়ে ২দিন পর উদ্ধার হলেও সে ঘটনায় ভয়ে মামলা করেনি তার পরিবার। সাইফুল ইসলাম জানান, আমাকেও পরিচিতজনের মতো ফোন করে ডেকে নিয়ে অপহরণ করে ওই চক্রটি। পরে বিকাশের মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার টাকা দিলে আমাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা।
এ বিষয়ে বারবাকিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মওলানা বদিউল আলম জিহাদীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, একের পর এক অপহরণের ঘটনায় আমরা আতংকে আছি। অপহৃত দুই ব্যক্তির বাড়ি বারবাকিয়ায় আর আটক ব্যক্তির বাড়িও বারবাকিয়ায় এবং দুই ব্যক্তি উদ্ধারও হয়েছে প্রায় একই এলাকা থেকে। সেজন্য আমাদের উদ্বেগটা একটু বেশি। আমরা এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। কেননা এ ঘটনার কোন সুরাহা না হলে আরো বড় ধরেণের ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানান তিনি।
পেকুয়া থানার ওসি (তদন্ত) মনজুরুল কাদের জানান, পেকুয়া বাজারের ব্যবসায়ী হারুণ অপহরণের ঘটনায় পেকুয়া থানায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা আটক ব্যক্তিকে রিমান্ডে এনে অপহরণের যাবতীয় রহস্য উদ্ঘাটন করব এবং ওই চক্রের প্রতিটি সদস্যকে ধরতে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন ক্লু যখন পাওয়া গেছে তখন আসামি ধরতে আর সমস্যা থাকবেনা।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার এসএসপি (চকরিয়া সার্কেল) কাজী মতিউল ইসলাম বলেন, এলাকার একটি ছোটখাট গ্রুপ এ অপহরণের ঘটনা গুলো ঘটিয়েছে। এগুলো নিয়ে আতংকিত হবার কিছু নেই। আমরা সব অপরাধীদের ট্রেস করতে পেরেছি। পুলিশ কাজ করছে। খুব শিঘ্রই অপহরণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আর ঘটনার তদন্তাকালে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে চেয়ারম্যান ও আর যত প্রভাবশালীই হোক তাকে ছাড় দেয়া হবে না।
পাঠকের মতামত: