ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

“পর্যটন খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে যা করণীয়”

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। এই শহরে ১২১ বর্গ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ঠ বালিয়াড়ি সৈকতকে ঘিরে নির্ভর করে এই অঞ্চলের ৬০ শতাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকা। ছোট্ট এ শহরে পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা প্রায় ৪শতাধিকেরও বেশি হোটেল-মোটেল জোন, ১৫০টিরও বেশি ছোট-বড় রেস্টুরেন্ট। এছাড়াও পর্যটনকে কেন্দ্র করে সৈকতের লাবণী পয়েন্ট, সুগন্ধ্যা, কলাতলী পয়েন্ট ও পৌর শহরের বার্মিজ মার্কেট, সূদুর কলাতলী হয়ে বিস্তৃত মেরিন ড্রাইভ সড়কের ইনানী ও হিমছড়ি সহ অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকদের আনাগোনা থাকায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, মহেশখালী দ্বীপ, রামু’র রাবার বাগান ও বৌদ্ধ মন্দির, নাইক্ষ্যংছড়ির শুড়ং, চকরিয়া উপজেলার দোলাহাজারার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কের মতো দর্শণীয় স্থান গুলোকে টার্গেট করে ট্যুরিজম ব্যবসায় খাতে জড়িত রয়েছে ৫০টিরও বেশি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। সবমিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার পেছনের মূল সম্পদ এই সমুদ্র সৈকত।

করোনা ভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে মার্চের শেষের দিক থেকে সরকারি সীদ্ধান্তের ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে বন্ধ হতে থাকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দিন দিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য পর্যটকদের সৈকত ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যা এখনও চলমান রয়েছে। পাশাপাশি বন্ধ রাখার সীদ্ধান্ত হয় সৈকত এলাকার সকল প্রকার হোটেল মোটেল জোন। প্রায় হোটেলের মালিক, রেস্টুরেন্ট ও ট্যুরিজম অফিসে কর্মরত কর্মচারীদের বেতন প্রদান করলেও বেশিরভাগ হোটেল মোটেল জোনের মালিকগণ কর্মচারীদের বেতন বকেয়া রেখেছেন। বিভিন্ন হোটেলে কর্মচারীদের সাথে কথা বললে বেতন বকেয়া রয়েছে বলে জানান। অন্যদিকে হোটেল মালিকদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের মধ্যে প্রায় বেশির ভাগই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া নিয়ে এসকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। করোনা ভাইরাসের এই সময়ে তারাও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। একদিকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ভাড়া পরিশোধ অন্যদিকে কর্মচারীদের মাসিক বেতন। এ যেনো উভয় সংকটে তারা। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার পর পর লকডাউনের তারিখ পবির্তন করছে। সর্বশেষ চলতি মে মাসের ১৬ তারিখ লকডাউন শীতিল করার কথা থাকলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আরও বেশি অবনতির দিকে ধাবিত হওয়ায় তা বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। সে সাথে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা। সামনে ঈদ, তাই সরকারের রয়েছে কঠোর নির্দেশনাও। তবে এসকল পর্যটন ব্যবসায়ের সাথে জড়িতদের চিন্তা ভাবনা ছিলো ঈদ মৌসুমে হয়তো কিছুটা হলেও ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি জানান দেয়, এখনও পূর্বের সীদ্ধান্তই বহাল থাকবে।

বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করা এই সৈকতের সাথে জড়িত পর্যটন ব্যবসায়ীদের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই পর্যটনখাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের পর্যটনখাতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ও কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ঠ মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ, প্রণোদনা ঘোষণা ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া খুবই জরুরি বলে মনে করছি। কেননা এই পর্যটনখাত যদি ঠিকিয়ে রাখতে চাই তাহলে এ খাতে জড়িতদের ভালো রাখতে হবে। দেশের এই দু:সময়ে তাদের পাশেও আমাদের দাঁড়াতে হবে। সাহায্য সহযোগিতা করতে গেলে কে কোন এলাকা থেকে এসে এখানে চাকুরি করছে তা বিবেচনায় না এনে তাদের কিছুটা হলেও সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এরাই পর্যটনখাতকে কাজে লাগিয়ে দেশের মূল অর্থনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যেনো সেজেছে এক ভীন্ন রূপে। সৈকতের বালিয়াড়িতে দেখা মিলেছে সাগরলতার। একদিকে সাগরলতার বাতাসের সাথে থাল মিলিয়ে দূল খেলানো, অন্যদিকে সাগরতীরে লাল কাঁকড়ার ঝাঁক সৈকতকে করেছে আরও প্রাণবন্ত। এ সৈকতের ঝাউবিথিও যেনো সেজেছে আপন মহিমায়। মাঝে মধ্যে সৈকতে দেখতে পাওয়া ডলফিন যেনো বাড়তি আনন্দ জোগাবে পর্যটকদের। ইনানী ও হিমছড়ির দিকে বৃক্ষের সুন্দর্য্য চোখে না দেখলে বর্ণনা করা প্রায় অনেকটা গল্পের মতো মনে হবে। কি সুন্দর প্রকৃতির সাজ! এদিকটাতে মাঝে মধ্যে হরিণ ও অন্যান্য ছোট বড় পশু ও সৈকত এলাকায় বিভিন্ন রঙ বেরঙ্গের পাখির আনাগোনা যেনো বাড়িয়ে দিয়েছে সুন্দর্য্য। এমন বিমুগ্ধ সমুদ্র সৈকত হাতছানি দিয়ে ডাকছে বারংবার। আর বলছে বিরতি দাও। আমরা বড্ড ক্লান্ত।

পর্যটনখাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে ও সৈকতের জীব-বৈচিত্র্যের কথা চিন্তা করলে বছরের কিছুটা সময় হলেও এখানে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। এতে করে প্রকৃতি ও সৈকতের সুন্দর্য্য যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে এ সৈকত। সৈকতের এমন সুন্দর্য্য তখন উপভোগ করতে ভীড় জমাবে দেশি-বিদেশি বাড়তি পর্যটক। এতে করে পর্যটনখাতে বাড়তি আয় দেশীয় অর্থনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

কক্সবাজার একটি জলবায়ু ঝুঁকি অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা দেশের কয়েকটি অঞ্চলের মধ্যে কক্সবাজারও রয়েছে। এ জেলার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়েছে এখানকার কয়েকটি গ্রাম। আর এসকল অঞ্চলের মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে বাঁচার তাগিদে কক্সবাজার শহরে এসে গড়ে তুলেছে তাদের বসতি। যদিও এসকল বসতি সৈকতের খুব সন্নিকটে তবুও ঝুঁকি নিয়ে এখানেই বসবাস করছেন ওই সকল লোকজন। গ্রাম থেকে শহরে এসে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ও নানান প্রতিকূলতায় তাদের বাঁচার আর্তনাদ। জলবায়ু ঝুঁকি বাস্তবিক অর্থে আমরা চাইলেই একেবারে নির্মূল করতে পারবো না। তবে আমরা ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনতে পারি। এই ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনতে আমাদের উপকূলীয় এলাকায় শক্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সামাজিক বনায়নের পরিমাণ বাড়ানোর প্রতি নজর দিতে হবে। বিশেষ করে কক্সবাজার সৈকতের নাজিরারটেক এলাকা ও নুনিয়ারছড়া এবং কুতুবদিয়া পাড়ায় শক্ত বেড়িবাঁধ নিমার্ণ করতে হবে।

পাশাপাশি নাজিরারটেক থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। অন্যদিকে কলাতলী থেকে টেকনাফের যেখানে মেরিন ড্রাইভের সমাপ্তি হয়েছে সেখানেও যেসকল জায়গায় একেবারে বনায়ন করা হয়নি কিন্তু বনায়নের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে সেই জায়গাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। করোনা ভাইরাসের এই সময়ে যেহেতু পর্যটন স্পটগুলোতে অবাধে মানুষের যাতায়াত নেই, সেহেতু এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে বৃক্ষরোপণ করা যেতে পারে। এতে করে যেমন সৈকত রক্ষা পাবে তেমনি বাড়বে সৈকতের সুন্দর্য্যও। কক্সবাজার সৈকতকে টিকিয়ে রাখতে হলে সামাজিক বনায়নের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। যদি বনায়নের পরিমাণ বাড়ানো না যায় তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিলীন হবে এ সৈকত। সে সাথে পর্যটনখাত থেকে আয়ের চিন্তা ভাবনা হবে অনেকটা স্বপ্নের মতো। একই সাথে বেকার হয়ে পড়বে পর্যটনখাতের ওপর নির্ভর করে ঠিকে থাকা ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ।

লেখক- মো. ওমর ফারুক জয়
গণমাধ্যমকর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা-উই ক্যান

পাঠকের মতামত: