চকরিয়া প্রতিনিধি :::
কক্সবাজারের চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের প্রপার কাকারায় মাতামুহুরী নদীর ভাঙন ঠেকাতে ফেলা হচ্ছে বালুভর্তি ১৪ হাজার বস্তা (জিও ব্যাগ)। এতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আশা করছেন, আসন্ন বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্রপার কাকারার তেমন ক্ষতি হবে না।
তবে এলাকাবাসীর দাবি, জরুরি কাজের বিপরীতে ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া বালুভর্তি বস্তা (জিও ব্যাগ) ডাম্পিংয়ের কাজটি টেকসইভাবে করতে হবে। কাজটি যাতে টেকসই এবং মানসম্মতভাবে হয় সেজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তার পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে সরকারি টাকা বরাবরের মতোই জলাঞ্জলি হবে। শুধু লোক দেখানো কাজ না করে জনগণের উপকার হয় সেভাবে কাজটি যথাযথভাবে ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেওয়ারও দাবি জানান এলাকাবাসী।
প্রপার কাকারা এলাকার বাসিন্দা, রাজনীতিবিদ আশরাফুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘প্রপার কাকারা এলাকার মানুষের জন্য মারাত্মক অভিশাপ হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে মাতামুহুরী নদীর ভয়াবহ ভাঙন। প্রতিবছর বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে এই অংশের ব্যাপক ভাঙনের কবলে পড়ে অনেকের ভিটে-বাড়ি পর্যন্ত নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে ইতিপূর্বে। এমনকি কাকারা-মাঝেরফাঁড়ি সড়কের প্রপার কাকারা অংশটিও তলিয়েছে নদীতে। বর্তমানে মানুষের বসতভিটার উপর দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। ’
তিনি অভিযোগ করেন, গত পাঁচ বছরের মধ্যে একাধিকবার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে। উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে আরসিসিসহ গাইডওয়াল নির্মাণ করা হলেও তা টেকসই না হওয়ায় বন্যার প্রথম ধাক্কাতেই নদীতে তলিয়ে যায় সেই গাইডওয়াল। এর পর অনেক আবেদন-নিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর ভাঙন ঠেকাতে কোটি টাকা ব্যয়ে বালুভর্তি বস্তা বিছিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বালুর সঙ্গে সিমেন্ট মিশ্রিত না করায় গতবারের ভয়াবহ বন্যার প্রথম ধাক্কাতেই বিলীন হয়ে যায় সেই বালুভর্তি কয়েক হাজার বস্তা।
আশরাফুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘এবার নতুন করে জরুরি কাজের বিপরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড উদ্যোগ নিয়েছে ২৫০ কেজি ওজনের বালুভর্তি করে ১৪ হাজার বস্তা ডাম্পিংয়ের। আমরা আশা করছি, এবার হয়তো বন্যার ধাক্কা সামলানো যাবে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা যথাযথ তদারকি না করলে নিয়োজিত ঠিকাদারের যেনতেনভাবে কাজ সম্পন্ন করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ’
স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ইতিপূর্বেও কোটি টাকা খরচ করে প্রপার কাকারার ভাঙন ঠেকাতে বালুর বস্তা বিছানো হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে। কিন্তু তা টেকসই এবং যথাযথভাবে সম্পন্ন না করায় সামান্য বৃষ্টিতে সেই বস্তা ছিঁড়ে যায়। ওই সময় মানসম্মতভাবে কাজ সম্পন্ন করতে বার বার তাগাদা দেওয়া হলেও কেউ শোনেননি সেই কথা। ঠিকাদার এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা মিলে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে খেয়েছেন সেই টাকা। এবার দেখছি বালুভর্তি করে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের একটাই দাবি, এসব কাজ যেন মানসম্মতভাবে করা হয়, সেজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় তদারকি করার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে বরাবরের মতো সরকারি টাকা পানিতেই ভেসে যাবে। ’
এলাকাবাসী জানান, মাতামুহুরী নদীর প্রপার কাকারা অংশের তীর সংরক্ষণ বাঁধ (সিসি ব্লক) ধসে পড়ে ২০১৫ সালের জুন মাসে। এর ফলে কাকারার সাথে চকরিয়া উপজেলার চলাচলের একমাত্র সড়কটি ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে টাকা বরাদ্দ দিয়ে সিমেন্ট কংক্রিট (সিসি) ব্লকের বদলে সিমেন্ট মিশ্রিত বালি দিয়ে কাজ শুরুর ঘোষণা দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু সেই জরুরি মেরামতের কাজ শুরু হয় ১০ মাস পর।
ওই সময় তীরসংরক্ষণ বাঁধে ২০ হাজারের মতো বস্তা ফেলার কাজ বর্ষার আগে দ্রুত শেষ করার জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্টদের।
এলাকাবাসী আরো জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার জেলায় আগামী তিন বছরে ২৫৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এতে ৬০ কিলোমিটার তীররক্ষা বাঁধ মেরামত, ১৬ কিলোমিটার প্রতিরোধ বাঁধ নির্মাণ করা হবে। সেই প্রকল্পে মাতামুহুরীর প্রপার কাকারার এই অংশটিও যুক্ত করার দাবি এলাকাবাসীর।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭-৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক মাতামুহুরী নদীর গতিপথের পরিবর্তন ঠেকিয়ে ভাঙন রোধ করতে কাকারা মেনিবাজার স্থান থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। এর পর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মেনিবাজার থেকে প্রপার কাকারায় প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ সিসি ব্লক বসিয়ে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছিল ১২ কোটি টাকা। বাঁধটি পর্যায়ক্রমে চিরিঙ্গা মাতামুহুরী সেতু পর্যন্ত নেওয়ার কথা থাকলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
কাকারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শওকত ওসমান বলেন, ‘ইমার্জেন্সি ওয়ার্কের বিপরীতে দুই প্যাকেজের মাধ্যমে ইউনিয়নের প্রপার কাকারা পয়েন্টের মাতামুহুরী নদীতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে ১৫ দিন আগে থেকে। এর মধ্যে এবার প্রতিব্যাগে ভর্তি করতে হবে ২৫০ কেজি বালু, যা আগেরবার ছিল মাত্র ৫০ কেজি। তাই আশা করা যাচ্ছে এবারের বালুভর্তি জিও ব্যাগ টেকসই হবে। এতে এবারের বন্যায় প্রপার কাকারার ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হবে। তবে কাজ যাতে যথাযথ এবং মানসম্মতভাবে সম্পন্ন হয় সেজন্য বেশ তদারক করা হচ্ছে। ’
পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার ও বান্দরবানের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এস ই) আজিজ মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীর ভাঙন থেকে প্রপার কাকারাকে রক্ষার জন্য দুই প্যাকেজে জরুরি ভিত্তিতে ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে বালুভর্তি জিও ব্যাগ বসানোর কাজ শুরু করা হয়েছে সম্প্রতি। এই কাজ যাতে যথাযথ এবং মানসম্মতভাবে সম্পন্ন হয় সেজন্য ঠিকাদারকে
কড়া নির্দেশনা দেওয়া আছে। পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন এই কাজের। ’
পাঠকের মতামত: