ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের ফ্লাইট অপারেশন

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ::
কক্সবাজার বিমানবন্দরের উড়োজাহাজ মেরামত ও মেইনটেন্যান্স ধোলাইখাল স্টাইলে চলছে। মেরামতের জন্য এখানে নেই কোনো হ্যাঙ্গার। প্রকাশ্যে খোলা আকাশের নিচে খোলা হচ্ছে উড়োজাহাজের স্পেয়ারপার্টস।

বিমান সংস্থাগুলো এসব স্পেয়ারপার্টস যেসব হ্যাঙ্গার বা গুদামে রাখছে সেগুলোরও অনুমোদন নেই। এলোমেলো ও বিশৃঙ্খলভাবে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো দেখলে মনে হয় আরেক ধোলাইখাল।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও বৈধ ভিসা ছাড়া বিদেশিরা এই বিমানবন্দরে প্রবেশ ও উড়োজাহাজ মেইনটেন্যান্সের মতো স্পর্শকাতর কাজ করছে। বিমানবন্দরে প্রবেশে তাদের নেই কোনো বৈধ পাশ।

এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্সের জন্য আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেটও নেই। বিমানবন্দরের বাইরে টিনশেড গুদামঘরকে হ্যাঙ্গার বানিয়ে রাখা হচ্ছে উড়োজাহাজ মেরামতের মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও স্পেয়ারপার্টস।

সম্প্রতি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একটি উচ্চপর্যায়ের সার্ভিলেন্স টিম কক্সবাজার বিমানবন্দরে ঝটিকা অভিযানে গিয়ে এই চিত্র দেখতে পায়। বিষয়টি তারা তাৎক্ষণিকভাবে সংস্থাটির শীর্ষ পর্যায়ে অবহিত করেন।

এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) ও ডিপার্টমেন্ট অব ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্টকে চিঠি দিয়েছেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যে কোনো বিমানবন্দর একটি কেপিআই (কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন) স্থাপনা। এভাবে বৈধ পাশ, কাজের অনুমতি ও বৈধ ভিসা ছাড়া বিদেশি ইঞ্জিনিয়ারদের বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর জোনে প্রবেশ দেশের নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি। এ অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে এই বিমানবন্দরের ফ্লাইট অপারেশন।

বেবিচকের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড রেগুলেশনন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি এয়ারলাইন্স ট্রু এভিয়েশন এয়ারলাইন্স ও বিসমিল্লাহ এয়ারলাইন্স নামে দুটি বিমান সংস্থা এজন্য দায়ী। গত ১৪ মে বেবিচকের দুজন পরিদর্শক কক্সবাজার বিমানবন্দরে ঝটিকা পরিদর্শনে গিয়ে দুই এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজগুলোর এই চিত্র দেখতে পান।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে তারা দেখেন বিমানবন্দরে খোলা আকাশের নিচে দুজন বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার ট্রু এভিয়েশনের একটি উড়োজাহাজ মেরামত করছেন। বেবিচকের পরিদর্শকদের দেখে তারাও হতম্ভব হয়ে পড়েন। কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক আইন-কানুন না মেনে এভাবে দুই বিদেশিকে উড়োজাহাজ মেরামত করতে দেখে পরিদর্শকরা হতবাক হন। দুজনের কাছে বিমানবন্দরে প্রবেশের যে পাশ ছিল সেটি ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। ১৭ দিন আগে তাদের পাশের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।

শুধু তাই নয়, ভিসার মেয়াদও অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে তাদের। যে ভিসা নিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছিলেন সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, এ ধরনের ভিসায় তারা বেতনে কিংবা বিনা বেতনে কোনোভাবে বাংলাদেশে কাজ (চাকরি) করতে পারবেন না।

নিয়ম অনুযায়ী কোনো বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পাইলট বাংলাদেশি কোনো রেজিস্টার্ড এয়ারক্রাফটে কাজ করতে বা এয়ারক্রাফট চালাতে হলে সিভিল এভিয়েশনের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড রেগুলেশন বিভাগের অনুমতি নিতে হবে। দুই বিদেশির কাছে এ ধরনের কোনো অনুমতিপত্রও ছিল না। বেবিচকের অনুমতি ছাড়া কীভাবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিদেশিদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি এবং পাশ দিল তা নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম নিয়েও।

ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড রেগুলেশন্স বিভাগের পরিচালক মো. মুকিত উল আলম মিয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, পাশের মেয়াদ ও কাজের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও বিদেশিদের বিমানবন্দরে প্রবেশ বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি। বেবিচকের সদস্য পরিচালনা ও পরিকল্পনাকে দেওয়া ওই চিঠিতে তিনি দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের পাশ ইস্যু ও মেয়াদবিহীন পাশ নিয়ে বিদেশিদের প্রবেশের বিষয়টি তদন্ত করার অনুরোধ জানান।

শুধু তাই নয়, কক্সবাজার থেকে চিংড়ি পোনা বহনকারী কয়েকটি অভ্যন্তরীণ কার্গো উড়োজাহাজ আকাশপথে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে চলার অভিযোগ আছে।

জানা গেছে, উড়োজাহাজগুলোর অধিকাংশ কমপোনেন্ট ও স্পেয়ার পার্টসের মেয়াদ নেই। সিভিল এভিয়েশনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পোনা ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট মেয়াদোত্তীর্ণ এয়ারক্রাফট নিয়ে এ রুটে ব্যবসা চালাচ্ছে। উড়োজাহাজগুলোর অধিকাংশই ৩০-৩৫ বছরের পুরনো। জানা গেছে বিভিন্ন দেশের মেরামত হ্যাঙ্গারে পড়ে থাকা চলাচলের অযোগ্য এয়ারক্রাফট আমদানি করে ঝুঁকিপূর্ণ এই ব্যবসা করছে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সব জেনেও রহস্যজনক কারণে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ উড়োজাহাজগুলো আকাশে ওড়ার অনুমতি দিচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে ডেসটিনি গ্রুপের মালিকানাধীন একটি এয়ারক্রাফটের কমপক্ষে ২৬টি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সরেজমিন পরিদর্শন করে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) দিয়েছিল সিভিল এভিয়েশনের একটি টিম। পরবর্তী সময়ে ওই ঘটনা ফাঁস হলে ওই এয়ারলাইন্সের এওসি (এয়ার ওয়ার্দিনেস সার্টিফিকেট) বাতিল করা হয়।

তারও আগে কক্সবাজারসংলগ্ন সাগরে একটি এয়ারক্রাফট (এএন-২৬) বিধ্বস্ত হয় যার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। উড়োজাহাজটির একটি ইঞ্জিন বছরের অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকত। ওই এয়ারক্রাফটির মালিকও ছিলেন এই ট্রু এভিয়েশন।

জানা গেছে, ট্রু এভিয়েশনের পরিচালনায় একই মডেলের দুটি পুরনো এয়ারক্রাফট ছিল। অভিযোগ একটির পার্টস ও যন্ত্র নষ্ট হলে দ্বিতীয়টি থেকে ওই যন্ত্রটি খুলে লাগানো হতো। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এটি মারাত্মক অপরাধ ও ঝুঁকিপূর্ণ হলেও নির্বিকার ছিল বেবিচক ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এসব যন্ত্রাংশ স্থানান্তরের সময় সিভিল এভিয়েশনকে জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও মালিকপক্ষ তা করত না। উড়োজাহাজটির পাওয়ারকাট-পিসিটিও (ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার যন্ত্র) প্রায়ই বিকল থাকত। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দেশীয় কোনো পাইলট ট্র– এভিয়েশনের ফ্লাইট চালাতেন না। বাধ্য হয়ে বিদেশি পাইলট ভাড়া করে ফ্লাইট চালানো হতো।

জানা গেছে, এএন-২৬ মডেলের যে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছিল সেটি এক সময় মেয়াদহীন এক্সচুয়েটর ফুয়েল কক নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করেছিল। এয়ারক্রাফটটির গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র সুইচ টেম্পারেচারটিও প্রায়ই নষ্ট থাকত। বিধ্বস্ত হওয়ার আগে এয়ারক্রাফটের ৪টি প্রধান ব্যাটারির মেয়াদ ছয় মাস আগেই উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরে নন-শিডিউল ফ্লাইটে ঘুস লেনদেন হয় মার্কিন ডলারে। পোনা বহনকারী এসব ফ্লাইটের শিডিউল পেতে মোটা অঙ্কের টাকার ঘুস দিতে হয়। মাছের পোনা বহনকারী কার্গো ফ্লাইটগুলোতে ঘুসের রেট আকাশচুম্বী। কারণ এসব ফ্লাইটে পোনার কনটেইনারে গোপনে পাচার হয় ইয়াবাও।

তবে ট্রু এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বলেছে ভিন্নকথা। প্রতিষ্ঠানের সিইও উইং কমান্ডার হাসান মাসুদ বলেন, বর্তমানে তাদের এয়ারলাইন্স কোনো ফ্লাইট অপারেশন করছে না। তাদের এয়ারক্রাফটগুলোর এওসিও নেই। তারপরও হঠাৎ করে সিভিল এভিয়েশন থেকে টিম গিয়ে অভিযান চালানো রহস্যজনক। তিনি বলেন, যে টিমটি অভিযান চালিয়েছে তারা জোরপূর্বক তাদের বিমানের ছবি তুলেছে। তাদের বিদেশি ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। তিনি বলেন, দুই ইন্সপেক্টর তাদের ওয়ার্কশপে গিয়ে তাদের অনুমতি ছাড়া ভিডিও ধারণ করেছে। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য তারা সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত চিঠি দিয়েছেন বলেও তিনি জানান।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার বিমানবন্দরের দায়িত্বরত কর্মকর্তা গোলাম মুর্তজা হোসেন বলেন, সাধারণত যারা বিমানবন্দরে কাজ করতে আসেন তাদের ভেলিড ডকুমেন্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর পাশ দেওয়া হয়। পাশবিহীন কারও বিমানবন্দরে প্রবেশের সুযোগ নেই। বিদেশি কোনো ইঞ্জিনিয়ার পাশ ছাড়া বিমানবন্দরে প্রবেশ করেছেন কিনা সেটা তিনি তদন্ত করে দেখবেন বলে জানান।

পাঠকের মতামত: