ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

জেলায় পাহাড় ধসের আশংকা

চলতি বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজার শহরের পর্যটন এলাকায় পাহাড় ধসের আশংকা করা হচ্ছে। শহরে পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধ বসতি স্থাপনের সুবিধার্থে পাহাড় কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব কাটা পাহাড়ের নিচে হাজার হাজার বসতি স্থাপন করে বসবাস শুরু করেছে অবৈধ বসবাসকারীরা। যার ফলে প্রতি বৎসর বর্ষা মৌসুমে কোন না কোন পাহাড় ধসের দূর্ঘটনায় প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে।
দীর্ঘ তাপদাহের পর বৃষ্টি শুরু হলে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যায়। তাই এসময় পাহাড় ধসে পড়ার আশংকা থাকে বেশি। এতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর উপজেলা সহ প্রত্যন্ত অঞ্চল। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক পাহাড়ে অবস্থানরত মানুষদের মাইকিং করে অবগত করানো হইলেও তেমন একটা ফল পাওয়া যাচ্ছে না মনে করছেন জেলার সচেতন মহল। সচেতন মহলের দাবি, শহরের ঘোনার পাড়া, বৈদ্যঘোনা, পাহাড়তলী, লাইটহাউজ পাড়া, সাহিত্যিকাপল্লী, মোহাজের পাড়া, বাদশাঘোনা, কলাতলী, বিজিবি ক্যাম্প এলাকা সবার্ধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রতি বৎসর হালকা ও মাঝারি ধরণের কিংবা ভারী বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনায় প্রাণহানী ঘটছে প্রতিনিয়ত। কক্সবাজারে নিন্মচাপে ভারী বর্ষনের সময় সতর্কতা সংকেত থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কর্তৃক তা মাইকিং করা জানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এসব মাইকিং করে অবগত করানো কিংবা পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সরিয়ে যেতে বলা হলে তা বসবাসরতরা তেমন একটা কর্ণপাত করেন না। যার কারণে ভারী বষর্ণে পাহাড়ের নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে অবৈধ বসবাসকারীদের।
জানা গেছে, পাহাড়ে নিচে অবৈধ জনবসতি স্থাপনা নির্মাণ করে অবস্থান করার কারণে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আবহাওয়া বার্তার গুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজার রাডার স্টেশনের পশ্চিমাংশের ভূমি হঠাৎ ধসে পড়লে দু’টি পরিবারের শাহ আলম (৪৫), তাঁর স্ত্রী রোকেয়া আক্তার (৩৩), তাঁর ভাতিজি রিনা আক্তার (১৬) এবং পাশের পরিবারের জুনু বেগম (২৮), তাঁর মেয়ে নীহা মনি (৭) সহ ৫ জন মুহুর্তের মধ্যে মর্মান্তিক প্রাণহানী হয়। এতে আহত অবস্থায় উদ্ধারও করা হয় কয়েকজনকে। ঘটনাটি ঘটে গত বৎসরের ২৭ জুলাই কক্সবাজারের দক্ষিণ বাহারছড়া এলাকার জেলা রেজিষ্ট্রার কার্যালয়ের পূর্ব পাশের হিলটপ সার্কিট হাউজের কক্সবাজার রাডার স্টেশনের পশ্চিম পাশের এলাকায়। গত বৎসরের ১ সেপ্টেম্বর ঝিলংজার মুহুরী পাড়া এলাকার আবু তাহের নবম শ্রেণী পড়–য়া কন্যা ফারজানা আকতার পাহাড় ধসে প্রাণ হারান। এছাড়াও গত কয়েক বৎসর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালের ১৫ জুন হিমছড়ি এলাকায় সেনা ক্যাম্পে ৬ সেনা সদস্য নিহত হন পাহাড় ধসে। একই সময়ে টেকনাফ, রামু, কক্সবাজার শহরসহ অর্ধ শতাধিক নিহত হন পাহাড় ধসে। এইভাবে প্রতি বৎসর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর পরই প্রবল বর্ষণে কিংবা মাঝারি বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসে নিহত হওয়ার আশংকা বেড়ে চলেছে।
লাইটহাউস পাড়া সরওয়ার আলম বলেন, ‘পাহাড় ধসে মৃত্যু এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক বৎসর পূর্বে রাডার স্টেশনের পশ্চিম পাশের পাহাড় ধসে ৫ জন নিহত সহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। ঝুঁকি থাকা সত্বেও অবৈধ বাসস্থান গড়ে বসবাস শুরু করা হচ্ছে পাহাড়ের নিচে। সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি সময়ে সতর্কতা বার্তা দেওয়া হলেও তেমনটা সুফল লক্ষণীয় নয়। মাইকিং করে প্রচার বার্তায় অবৈধ বসবাসকারীদের প্রশাসন সাময়িকের জন্য নিরাপদে নিলেও পুরোপুরি ঠেকানে যাচ্ছে না পাহাড় ধসের মৃত্যু।’
শহরের বৈদ্যঘোনা এলাকার শেফায়েত উদ্দিন নামে স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘মাইকিং কিংবা প্রচার-প্রচারণায় পুরোপুরি পাহাড় ধস ঠেকানো যাবে না। পাহাড়ের নিচে অবৈধ বসবাসকারীদের অনতিবিলম্বে কক্সবাজারের বৃহৎ স্বার্থে সড়িয়ে নিতে হবে। উচ্ছেদ করতে হবে অবৈধ স্থাপনা। নতুন করে পাহাড়ের নিচে যাতে কেউ অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলতে না পারে তা প্রশাসনের নজরদারিতে রাখতে হবে।’
বইল্যাপাড়া এলাকার মোহাম্মদ কাসেম বলেন, ‘দখল বিক্রয় জেলায় কমন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় সরকারি ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত জমি। অথচ খন্ড খন্ড করে পাহাড়ের পাদদেশের জমি বিক্রয় করছেন সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মহল। এসব প্রভাবশালী মহলের আশকাড়ায় দিন দিন বেড়ে চলছে পাহাড় কাটা ও পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধ বসবাস। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তারাও এক্ষেত্রে জড়িত থাকেন। এসব অবৈধ বসবাসকৃত খাস জমি অনেক সময় সরকার কর্তৃক ভূমিহীন উল্লেখ করে দীর্ঘ মেয়াদী লীজ নিতেও  তৎপর হতে দেখা যায়। লীজ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দফ্তরের যোগসাজসে অবৈধ সৃজিত খতিয়ান সৃজনের মাধ্যমে স্থায়ী অবৈধ বসবাস করতেও দেখা যাচ্ছে। যা কক্সবাজার সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত।’
সচেতন মহলের মতে, বিভিন্ন সমস্যার কারণে কক্সবাজার একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। হাজারো সমস্যার মধ্যে জেলায় পাহাড়ের নিচে বসবাস আলোচিত ইস্যু। পাহাড়ের বন উজার ও ভূমি ক্ষয়ের কারণে প্রাকৃতিক দূর্যোগ সহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন জেলাবাসী। নির্বিচারে পাহাড় কাটা ও গাছপালা কর্তন রোধ যেন কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। যার কারণে বেড়ে চলছে অবৈধ বসবাসকারী স্থাপনা। নির্দিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট দফ্তরের সরজমিনের পরিদর্শন কার্যক্রম অব্যাহত না থাকায় তা আরও বাড়ছে। অনতিবিলম্বে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা না করলে এবং অবৈধ স্থাপনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পাহাড় নিচে অবৈধ বসবাসের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
সম্প্রতি এক সেমিনারে কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘কক্সবাজার জেলায় বর্তমানে পাহাড়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করছে। প্রতিদিন পাহাড় কেটে নতুন বসতি তৈরী করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মোট বনভূমির ৩০ শতাংশের বেশি বেদখল হয়ে গেছে। পাহাড়ে বসতি গেড়েছে ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা।’
জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার উত্তর দক্ষিণ বিভাগ, চট্টগ্রাম উপকূলীয় বনবিভাগ ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার জেলায় পাহাড় ও বনভূমির মোট পরিমাণ ৮৯ হাজার ১৬২ হেক্টর। তার মধ্যে বেদখল হয়ে গেছে ২৩ হাজার ৫৪ হেক্টর পাহাড়ি জমি। চট্টগ্রাম উপকূলীয় বনবিভাগের আওতায় মহেশখালী দ্বীপে মোট বনভূমির পরিমাণ ৭ হাজার ৩১৪ হেক্টর, এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ২ হাজার ৪ হেক্টর বেদখলে। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগে মোট ৩২ হাজার ৮১৬ হেক্টরের পাহাড়ির ভূমির মধ্যে জবরদখল হয়ে গেছে ৫ হাজার ৩৪১ হেক্টর। কক্সবাজার দক্ষিন বন বিভাগে ৪৪ হাজার ১৭৪ হেক্টরের মধ্যে বেদখলে চলে গেছে ১২ হাজার ৪৫৫ হেক্টর পাহাড়ি বনভূমি। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগের আওতাধীণ পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া বনরেঞ্জের অধীনে ৪ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমির মধ্যে বেদখল হয়ে গেছে প্রায় ২ হাজার হেক্টর। কক্সবাজার জেলা শহর তার নিকটবর্তী এলাকায় ১৪টি পাহাড় নিয়ে ৮৫৮ হেক্টর পাহাড়ি ছিল বনবিভাগের মালিকানাধীন। ১৯৮৮ সালে ওই পাহাড়ি জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভূক্ত করা হয়। বনবিভাগের পরিবর্তে ওই পাহাড়ি জমির মালিক হয়ে যান সরকারের পক্ষে জেলা কালেক্টরেট অর্থাৎ জেলা প্রশাসক। ওই ৮৫৮ হেক্টর পাহাড়ের প্রায় জমি ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে।

পাঠকের মতামত: