ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

জখমি সনদ বাণিজ্যে মামলাজট

drমাহবুবুর রহমান, কক্সবাজার ::::
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের জখমি সনদ নিয়ে আদালতে মামলাজট বাড়ছে। একই সাথে এসব জখমি সনদের অপব্যবহার করে অনেক সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন জেল খাটছে। আবার সেসব জখমি সনদ নিয়ে খোদ আদালতও অনেক সময় সন্দিহান হয়ে পড়ে বলে জানান আইনজীবীরা। এতে একদিকে আদালতের সময় নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে বিচার প্রত্যাশিরা হয়রানীর শিকার হচ্ছে। এদিকে বেশ কয়েকটি মামলায় প্রদর্শন করা জখমি সনদ নিয়ে আদালত আগেও পূর্ণ প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিলেও সম্প্রতি জিআর ৫৮/১৬ (কুতুবদিয়া) আদালত স্ব-প্রণোদিত হয়ে একটি মামলায় সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ সোলতার আহামদ সিরাজীর দেওয়া সার্টিফিকেট পূনঃতদন্তের জন্য সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দিয়েছে। এদিকে সচেতন মহলের দাবী সদর হাসপাতালের আরএমও কর্তৃক দেওয়া এসব জখমি সনদের কারনে অসংখ্য মানুষ হয়রানী হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এড. হারুন উর রশিদ বলেন, প্রতিদিন আমরা মামলা পরিচালনা করার সময় দেখি জেলা সদর হাসপাতাল থেকে প্রেরিত জখমি সনদ নিয়ে অনেক বিড়ম্বনা সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন নিময় অনুযায়ী গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেট ইস্যু করার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের নিয়মের বাধাবাধ্যকতা থাকলেও সেসব কিছুই মানা হচ্ছে না। যার নামে গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে দেখা গেছে সে নিজেই হেটে আদালতে আসছে, তাও এক দুই দিনের মধ্যে, কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সেই ব্যক্তি হাসপাতালের বেডে থাকার কখা, কারন যার অঙ্গহানি হয় সেই ব্যক্তি কখনো এক দ্ ুদিনের মধ্যে আদালতে আসতে পারে না। সত্যি কথা হচ্ছে আমরা অনেক সময় পক্ষে বিপক্ষে পেশাগত কাজ করতে গিয়ে দেখি জখমি সনদ প্রদানে বেশ অনিয়ম হচ্ছে। এতে অনেক নিরীহ মানুষ হয়রানী হচ্ছে, দীর্ঘদিন জেল খাটছে। আবার অনেক প্রকৃত দোষি ব্যক্তিও নিরাপদে ঘুরছে। তাই জখমি সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে আরো সচতেন হওয়া দরকার।
একইভাবে এড. আবু ছিদ্দিক ওসমানী বলেন, সব জখমি সনদ যে একেবারে সঠিক নয় আমি সে কথা বলবো না, তবে অনেক গুরুত্বর জখমি সনদ বিষয়ে আসলেই সন্দেহ জাগে। কারন সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা হয়েছে যেই ব্যক্তির মাথায় গুরুতর জখম সেই ব্যক্তি দিব্যি সুস্থভাবে চলাফেরা করছে। বেশিরভাগ মামলায় প্রদর্শন করা সার্টিফিকেট নিয়ে অনেক সময় বিজ্ঞ বিচারকরা সন্দিহান হয়ে পড়ে। তাই অনেক সময় সেইসব সার্টিফিকেটগুলো পূনঃতদন্তের জন্য দেওয়া হয়। এতে সাধারণ মানুষজন নানান ভাবে হয়রানীর শিকার হয়। এতে একদিকে আদালতের সময় নষ্ট হচ্ছে, মামলাজট বাড়ছে, অন্যদিকে বিচার প্রত্যাশিরাও আর্থিক ও সময়ের দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। এ সময় তিনি বলেন, আমার জানা মতে জখমি সনদ দিতে ৩ জন ডাক্তারের স্বাক্ষর লাগে কিন্তু প্রায় সময় দেখি সেখানে ডাঃ সুলতান আহাম্মদ সিরাজী নিজেই দুটি স্বাক্ষর করে, বিষয়টি  আদৌ সঠিক কিনা সেটা সিভিল সার্জন অফিসের নজর দেওয়া দরকার।
এদিকে কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে জিআর ৫৮/১৬ ( কুতুবদিয়া) একটি মামলায় গত বছরের ২৫ জুলাই সংগঠিত একটি ঘটনায় ভিকটিম জান্নাতুল ফেরদৌসকে জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ডাঃ সুলতান আহামদ সিরাজী স্বাক্ষরিত প্রদত্ত গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেটের ব্যাপারে আদালত আদেশ বলে জখমি সনদে ডাক্তার নিজেই এক্সরে এবং সিটিস্কেন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেও তিনি এক্সরে বা সিটিস্কেন না করেই গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেট দিয়েছে। আর সনদের লেখায় এক জায়গায় মে শব্দ দ্বারা সম্ভব্যতার কথা বুঝানো হয়েছে। তাই সম্ভাব্যতা দিয়ে বা অনুমান নির্ভর হয়ে গ্রিভিয়াস সনদ দেওয়া যায় না। অথচ এই জখমি সনদের ফলে আসামী ৫ মাস ধরে জেলে আছে। তাই বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক  মোহাম্মদ তৌফিক আজিজ সেই সনদটির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে পুনরায় প্রতিবেদন দিতে সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে গতকাল কক্সবাজার কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় মামলা সংক্রান্ত কাজে আসা টেকনাফ হলবুনিয়া এলাকার এনামুল হক জানান, তার নিকট আত্মীয় মোহাম্মদ ইসমাইল এবং রাহমত উল্লাহর মামলা নিয়ে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করতে এসেছিলাম। আসলে এখানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ডাঃ সুলতান আহামদ সিরাজীর দেওয়া একটি সম্পূর্র্ণ মিথ্যা জখমি সনদের কারনে আমার আত্মীয়রা জেল খাটছে। এখানে হোসেন আহামদ এবং খালেদা আকতারকে কি কারনে গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেট দিয়েছে সেটা বুঝতে পারছি না। আমাদের আইনজীবী বলছেন সেখানেও নাকি অনুমান নির্ভর হয়ে গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে যা সম্পূর্ন বে আইনী। আসলে আমার যখন সেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম তখন তার এক পিয়ন আমাদের বিশাল একটি টাকার দাবী করেছিল। আমরা গরিব মানুষ এত টাকা কিভাবে দেব। টাকা দিতে না পারায়  আমরা সন্দেহ করছি অপর পক্ষ থেকে টাকা নিয়ে এই মিথ্যা সনদ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে এপিপি এড. তাপস রক্ষিত বলেন, অনুমান নির্ভর কোন জখমি সনদ হতে পারে না। যেমন রহিম করিমকে হত্যা করতে পারে সেখানে ৩০২ ধারা হতে পারে না। তাই মোহাম্মদ হোসেন এবং খালেদা আকতারের জখমি সনদে অনুমান নির্ভর গ্রিভিয়াস সার্টিফিকেট হতে পারে না। এখানে সম্ভাব্যতা নিয়ে সার্টিফিকেট হতে পারে না। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ৩ জন ডাক্তারের স্বাক্ষর থাকার কথা থাকলেও সেটাও নেই।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ সোলতান আহামদ সিরাজী সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয় অস্বীকার করেছেন। আর তিনি আরএমও হিসাবে একটি এবং ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার হিসাবে আরেকটি স্বাক্ষর করেন বলে জানান। আর আদালতের নির্দেশ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এব্যাপারে কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডাঃ পুচনু বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ সদস্যের একটি কমিটি সেই বিষয়ে তদন্ত করছে।

পাঠকের মতামত: