চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এলাকায় রেলপথ নির্মাণের কথা ব্রিটিশরা ভেবেছিলেন ১২৫ বছর আগে। দেরিতে হলেও এখন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এর আগে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেই বেশি মনোযোগী ছিল রেলওয়ে। বর্তমানে চলছে এই প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। প্রকল্পের কাজে গতি আসায় ট্রেনে চড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে পার্বত্যাঞ্চলবাসী।
সাধারণত এ ধরনের প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণকালে স্থানীয়দের কাছ থেকে নানা আপত্তি আসে। অথচ প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিচ্ছেন ভূমি মালিকসহ ন্থানীয়রা।
বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় সড়কপথে যাতায়াত করতে হয়। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির মানুষ ভাবেননি তারা কোনোদিন ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পাবে। আরামদায়ক, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত রেলপথ এখন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে চালুর প্রক্রিয়ায় তাদের প্রত্যাশার পরিধিটা বেড়েছে। কারণ দোহাজারী-কক্সবাজার ও রামু থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ চালু হলে সেখানকার লোকজন ট্রেনে চড়েই বাড়ির কাছাকাছি পর্যন্ত যেতে পারবে। এটি পাড়ি দিতে এখন সড়কপথই তাদের একমাত্র ভরসা। এতে রয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি।
প্রস্তাবিত রেললাইনের এলাইনমেন্ট এলাকা ঘুরে এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে ১১টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার সেকশনে ৯টি; দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডোলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার এবং রামু-ঘুনধুম সেকশনে উখিয়া ও ঘুনধুমÑ এ দুটি স্টেশন থাকবে। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণ করা হবে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ। এ জন্য দোহাজারী-কক্সবাজার লাইনে নির্মাণ করতে হবে ৩৯টি মেজর ব্রিজ এবং রামু-ঘুনধুম লাইনে ১৩টি মেজর বিীজ। চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে কক্সবাজার রুটে ভ্রমণ করে দেখা গেছে, কিছু এলাকায় মহাসড়কের পাশ দিয়েই যাবে রেলপথটি। আবার অনেক স্থানে বেশ দূর দিয়ে চলবে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারী বর্ষণে ওই এলাকার রাস্তাঘাট যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বর্তমানে রাস্তার মান ভালো। কয়েক জেলার মানুষকে এই মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে হয় বলে সড়কটিতে থাকে বাড়তি চাপ।
চট্টগ্রামের কেরানীরহাট থেকে বান্দরবানে যাওয়ার পথে সড়কের পার্শ্ববর্তী লোকজনের সঙ্গে কথা হয় রেলপথটি নিয়ে। তারা বলেন, সরকার এ রেলপথটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও রেল কর্তৃপক্ষ এতদিন তা অনুধাবন করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় পাহাড়ি এলাকার মানুষ এবার ট্রেনের দেখা পাবেন। ট্রেনযোগে অনায়াসে যেতে পারবেন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে।
বান্দরবান থেকে কেরানীরহাট দিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পথে কথা হয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে। তারা বলেন, চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট অথবা নতুন ব্রিজÑ যেখান থেকেই মানুষ কক্সবাজারের দিকে যাক না কেন, দুর্ভোগ রয়েছেই। পথে পথে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া, নিম্নমানের গাড়ির আধিক্যÑ সব মিলিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যাতায়াত। ট্রেন থাকলে অন্তত এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে না।
কক্সবাজার শহর থেকে সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত যেতে যেতে আলাপ হয় কয়েক দর্শনার্থীর সঙ্গে। তারা বলেন, এ রুটে ট্রেন চালু হলে পর্যটকের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ বেড়ে যাবে। তা ছাড়া বিদেশি পর্যটকও বাড়বে। কক্সবাজারের সুগন্ধা, কলাতলী এবং লাবনী বিচ পয়েন্টে একাধিক পর্যটক ও ট্যুরিস্ট পুলিশ জানান, ট্রেনযাত্রায় পর্যটকরা বেশি নিরাপদ বোধ করবেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবিষ্যতে ডাবল লাইন নির্মাণের সংস্থানসহ এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৭৪১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার লাইনের জন্য ১ হাজার ৩৯১ একর ও রামু-ঘুনধুম লাইনের জন্য ৩৫০ একর। ভূমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে স্থানীয়রা বলেন, ভালো কাজে জমি দিতে আপত্তি নেই তাদের। কারণ রেলপথ তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকেও বলা হয়েছে, ভূমি অধিগ্রহণকাজে এখন পর্যন্ত কোনো আপত্তি আসেনি।
জানা গেছে, মিটারগেজের পরিবর্তে ডুয়েলগেজ নির্মাণ এবং কার্যপরিধি ও ডিজাইন স্ট্যার্ন্ডার্ড পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়েছে। ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ২০০১ সালে চূড়ান্তকৃত এলাইনমেন্টে মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতাল ও অন্যান্য স্থাপনার কারণে কিছু এলাকায় এলাইনমেন্ট পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ ছাড়া ২০০১ সালের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বান্দরবান এলাকায় রেলওয়ে এলাইনমেন্টে জমি অধিগ্রহণের জন্য বিস্তারিত মৌজা ম্যাপ না থাকায় ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব প্রণয়নের নিমিত্তে বিশদ স্টাডি করতে হয়। বলা যায়, অনেকটা অনুমাননির্ভর ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রথমবার।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় অর্থায়নের ব্যবস্থা ছাড়াই কাজে হাত দেয় রেলওয়ে। এ ছাড়া ছিল অনুমাননির্ভর ব্যয় নির্ধারণ। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এ রেলপথটির নির্মাণকাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়।
পাঠকের মতামত: