ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চলছে মৃত্যুর মিছিল, আইন লংগনের অভিযোগ হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
লবণ জল ও মাটির কাঁদায় সড়ক পিচ্ছিল, আঁকাবাঁকা-উচুনিচু ও সরু সড়ক, বিকল্প না থাকায় ছোট যান চলছে বাধ্য হওয়ায় মহাসড়কের চকরিয়ার ৩৯ কিলোমিটা অংশে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অকালে জীবন হারাচ্ছে নারী-পুরুষ শিশু, আহত হচ্ছে বেসুমার। প্রস্তাবিত ফোর লেইন সড়ক নির্মাণের সময় ছোট যান চলাচলের ব্যবস্থা করলে এবং মাটি ও লবণ পরিবহণকালে সড়েেক মাটি ও লবণজল পড়া বন্ধ হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানতে পারছেন না কেউই। একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ভাবিয়ে তুলেছে সকলকে। শুধুমাত্র একদিনের ব্যবধানে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুটি দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরে গেছে চার নারীসহ ১১ টি তাজা প্রাণ। আহত হয়েছে শিশু, নারীসহ ১৪জন। এতে মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে দেশের দক্ষিণ প্রান্তের ব্যস্ততম চট্টগ্রাম-ক

ক্সবাজার মহাসড়ক। যে সড়ক দিয়ে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ হাজার হাজার যাত্রী-সাধারণ যাতায়াত করে থাকেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল একেবারে নিষিদ্ধ করলেও তা মানছেন না সংশ্লিষ্টরা। সরকারের নেওয়া এই সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে মহাসড়কে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, ইজিবাইক টমটম, মাহিন্দ্রসহ আরো হরেক রকমের ত্রি-হুইলার বাহন। এমনকি লেগুনা-ছারপোকার মতো চার চাকার ছোট যানবাহনও মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ করলেও পাল্লা দিয়েই যাত্রী আনা-নেওয়া করছে প্রতিদিন।
আরো জানা গেছে, লবণ মৌসুমের সময় মহাসড়কে ওয়াটার প্রুপের ব্যবস্থা না করে লবণ বোঝাই গাড়ি চলাচলের কারণে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থান থেকে মাটি পরিবহণকালে গাড়ি থেকে সড়কে মাটি পড়ে, বৃষ্টির পর ওই লবণজল ও মাটি কাঁদায় পরিণত হয়ে সড়ক অত্যধিক পিচ্ছিল হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এতে মহাসড়কে চলাচলরত যাত্রীবাহি বাস ও ছোট যানবাহনগুলো দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এমনকি ৩৯ কিলোমিটার সড়করে পাহাড়ি ঢালার উঁচু-নিচু ও আঁকাবাঁকা অংশে দ্রুত গতির গাড়িগুলো ওভারটেকিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় বলেও নিসচার অভিমত।
অভিযোগ রয়েছে, মহাসড়কে এ ধরণের ছোট যানবাহন চলাচল একেবারে নিষিদ্ধ এবং আইন অমান্য করলে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য মহাসড়কের নিরাপত্তায় নিয়োজিত হাইওয়ে পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নানা কারণে এই নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারছেনা তারা। উপরন্তু হাইওয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন মহাসড়কে এ ধরণের যানবাহন চলাচল করছে। মূলতঃ ছোট যানবাহনগুলো মহাসড়কে উঠার কারণেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে প্রতিনিয়িত। আবার কেউ কেউ মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁককে (মোড় বা টার্ণিং) এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন।
গত বুধবার সকালের দিকে হঠাৎ করে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। এ সময় মহাসড়কের চকরিয়ার বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা থেকে যাত্রীবোঝাই করে হারবাংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ব্যাটারী চালিত একটি ইজিবাইক টমটম। এটি হারবাং স্টেশনের কাছে ইনানী রিসোর্টের সামনে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পণ্যবাহী দ্রুতগামী একটি কাভার্ড ভ্যানের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে দুইজনসহ মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় চারজন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে এক নারীও ছিলেন। আহত হন ইজিবাইকের শিশুসহ আরো চার যাত্রী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ব্যাটারী চালিত তিন চাকার ইজিবাইক টমটমটি যে চালাচ্ছিলেন মূলত তিনি একজন রিক্সা চালক। তিনি রিক্সা চালকের পেশা বদলে টমটম চালকে নিয়োজিত হয়েছেন কয়েকমাস আগে। মহাসড়কে গাড়ি চালানোর জন্য তার নেই কোন প্রশিক্ষণ। তাছাড়া টমটমটি যখন ইনানী রিসোর্টের সামনে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে পৌঁছে তখনই সে নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং বিপরীত দিক থেকে আসা কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে পতিত হয়। এতে বহুসংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
একইভাবে গত মঙ্গলবারের ভয়াবহ দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা এলাকার শামিম উদ্দিন নামের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, মহাসড়কে চার চাকার ছারপোকা গাড়ি নিষিদ্ধ থাকলেও রহস্যজনক কারণে এসব গাড়ি প্রতিদিন চলাচল করছে মহাসড়কে। একইভাবে মঙ্গলবার পৌণে বারোটার দিকে যাত্রীবোঝাই করে চিরিঙ্গা থেকে লোহাগাড়ার দিকে বেপরোয়াভাবে যাচ্ছিল ছারপোকা গাড়িটি। পথিমধ্যে বরইতলী নতুন রাস্তার মাথায় ছারপোকা গাড়িটি পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে বেপরোয়াভাবে আসা স্টার লাইন পরিবহনের যাত্রীবাহী অপর একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ছারপোকা গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলে কয়েকজন এবং তিন নারীসহ সাতজন ছারপোকার যাত্রী নিহত হন। আহত হন দুই গাড়ির অন্তত ১০ জন যাত্রী।
মহাসড়ক লাগোয়া স্থানীয় কয়েকজন সচেতন বাসিন্দা জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার ৩৯ কিলোমিটার অংশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নিয়োজিত রয়েছে বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা এবং মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি। এছাড়াও চিরিঙ্গা সদরের জন্য রয়েছে থানা ট্রাফিক সার্জেন্টের নেতৃত্বে পুলিশ। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্টরা দায়সারা দায়িত্ব পালন এবং সরকারের নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন না করায় মহাসড়কে ছোট ছোট যানবাহনগুলো চলাচল করছে।
তাদের অভিযোগ, ফাঁড়ির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মহাসড়কে ছোট যানবাহনগুলো চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করলেও অধস্তন কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তা না হলে সরকারের কঠোর নির্দেশনা সত্ত্বেও কিভাবে ছোট যানবাহনগুলো মহাসড়কে উঠতে পারে। এজন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
তবে সচেতন আরেকটি মহলের দাবি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া অংশে অধিকাংশ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ নানা স্থাপনা রয়েছে। এসব প্রতিষ্টানে যাতায়তের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ছোট ছোট এসব গাড়ি। যার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ এসব যানবাহনে চলাচল করতে বাধ্য হয়।
তারা দাবি করেন, মহাসড়ক হয়ে এসব প্রতিষ্টানে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষদের যাতায়তে মিনিবাস অথবা বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা করলে তারা আর ছোট যান নিয়ে যাতায়ত করবে না।
এ ব্যাপারে বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ‘সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক মহাসড়কে যাতে তিন ও চার চাকার ছোট যানবাহনগুলো উঠতে না পারে সেজন্য আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। অতিসম্প্রতি সরকারের কঠোর নির্দেশনার পর হাইওয়ে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের জনবল একেবারে স্বল্পসংখ্যক। তাই মহাসড়কের এই বিশাল অংশের পুরোটাই একচোখে পাহারা দেওয়াটা বেশ কষ্টকর। আর এর সুযোগ নিচ্ছে তিন ও চার চাকার ছোট ছোট যানবাহনগুলো। তবে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আরো বেশি কঠোর হবো আমরা। যাতে কোন অবস্থাতেই এ ধরণের যানবাহন মহাসড়কে উঠতেই না পারে।’
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চকরিয়া শাখার সভাপতি সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘একদিনের ব্যবধানে পর পর দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসের যেমন বেপরোয়া ভাব ছিল, তেমনিভাবে নিষিদ্ধ তিন ও চাকার ছোট যানবাহন মহাসড়কে চলাচল করায়।’
তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত হাইওয়ে পুলিশ কঠোরভাবে পালন না করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর হতে হবে এবং যাত্রী-সাধারণকেও বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। পাশাপাশি তিন ও চার চাকার নিষিদ্ধ ছোট যানবাহনগুলোর চালকসহ সংশ্লিষ্টদের সরকারের নির্দেশ মানতে হবে। তবেই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে এই দুর্ঘটনা থেকে। তা না হলে মহাসড়কে এভাবেই চলতে থাকবে নৈরাজ্য।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান পর পর দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘মহাসড়কের চকরিয়ায় এ ধরণের দুর্ঘটনার কারণ বের করতে ইতোমধ্যে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খোন্দকার মো. ইখতিয়ার উদ্দীন আরাফাতকে ওই কমিটির প্রধান করা হয়েছে। এছাড়াও কমিটিতে স্বাস্থ্য বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টদের সদস্য করা হয়েছে। এই কমিটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে।’
তিনি আরো বলেন, মহাসড়কে কোন অবস্থাতেই তিন বা চার চাকার যানবাহন চলাচল করতে পারবেনা। তাছাড়া হেলমেট বিহীন মোটরবাইক চালকদের তেল না দেওয়ার জন্য পেট্টল পাম্পগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্রমিক সংগঠনের বিভিন্ন নেতাদের এসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে।
আইন রক্ষা নাকি লঙ্গন?
মহাসড়কে তিন ও চার চাকার গাড়ি চলাচল বন্ধ করার নামে হাইওয়ে পুলিশ আইন লঙ্গন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সড়কে চলাচলরত গাড়ির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় মাতামুহুরী সেতুর উপর থেকে একটি টমটম নদীতে ফেলে দেয় ও তিনটি গাড়ির কাঁচ ভাংচুর এবং দুটি গাড়ি জব্দ করা হয়।
নদীতে ফেলে দেয়া টমটম মালিক ইয়াকুব নবী বলেন, ছয়জন শিক্ষার্থীর অনুরোধে আমি টমটম নিয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম। সেতু শেষ মাথায় পৌছলে চিরিংগা হাইওয়ে পুলিশের তিন সদস্য কোন ধরনের প্রশ্ন না করেই শিক্ষার্থী ও আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি নদীতে ফেলে দেয়।
অপরদিকে, একই অভিযোগ মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও। তারা আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে মহাসড়ক থেকে একটি ছারপোকা সড়ক থেকে পার্শ্ববর্তী একটি খালে ফেলে দেয়।
এব্যাপারে জানতে চাইলে মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশের এসআই আলমগীর বলেন, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই।
এব্যাপারে জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, আমাকে এ বিষয়ে কেউ জানায়নি। দুই হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বরতদের কাছ থেকে ঘটনা জেনে কি ঘটেছে বলতে পারবো।

পাঠকের মতামত: