উন্নয়নে অনিয়মের অভিযোগ
৫৮ কোটি ব্যয়: কাজ শেষের আগেই ভেঙ্গে যাচ্ছে সড়ক
নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের শান্তিবাজার থেকে কৈয়ারবিল ইউনিয়ন হয়ে লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন, কাকারা ইউনিয়ন ও সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়ন হয়ে পার্বত্য লামা উপজেলার ইয়াংছা বাজার পর্যন্ত ৫৭ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে চলতি অর্থবছরে ১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।প্রকল্পের দেখভালে নিয়োজিত সড়ক বিভাগের লোকজন খোদ এই অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন।
সম্প্রতি উন্নয়ন কাজে কার্যাদেশ লঙ্ঘন করে নিন্মমানের কাজের ঘটনায় বাঁধা দিতে গেলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছেন সড়ক বিভাগের এক কর্মচারীকে। এ ঘটনায় সড়ক বিভাগের চকরিয়া উপ-বিভাগের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে চরম ক্ষোভের পাশাপাশি উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। একইভাবে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয় জনসাধারণও।
এদিকে গত ঈদুল ফিতরের পূর্বে সওজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ২কোটি টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন এবং নতুন করে আবারো বিল জমা দিয়েছেন।
সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলতি অর্থবছর সড়ক ও জনপথ বিভাগ কক্সবাজারের আওতাধীন ৫৭ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী বরইতলী ইউনিয়নের শান্তিবাজার থেকে কৈয়ারবিল ইউনিয়ন হয়ে লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন, কাকারা ইউনিয়ন ও সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়ন হয়ে পার্বত্য লামা উপজেলার ইয়াংছা বাজার পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজটি পেয়েছেন আরএবি আরসি প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে নির্মাণ কাজ শুরু করেন ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক আবীর চৌধুরী প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং সড়ক বিভাগের বেশ ক’জন সিনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গে আতাতের মাধ্যমে সড়কের নির্মাণ কাজে নিন্মমানের উপকরণ সামগ্রী ব্যবহার করছেন। সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গাইড ওয়াল নির্মাণে আশ্রয় নেওয়া হয় চরম অনিয়মের।
সেকেন্ড ক্লাস (২নং) ইট, মাতামুহুরী নদীর কাঁদা বালু এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম সীমেন্ট দেয়ার ফলে গাইড ওয়াল নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পূর্বেই ভেঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গাইড ওয়ালে নিন্মমানের ইট ব্যবহারের কারণে স্থানীয় জনসাধারণ ও সওজের স্থানীয় কর্মচারীরা কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগও করেন। কিন্তু কোন প্রতিকার তারা পায়নি। ফলে সওজ কর্মকর্তাদের আস্কারা পেয়ে নিন্মমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
এদিকে নির্মাণ কাজে স্থানীয়ভাবে দেখভালে নিয়োজিত সড়ক বিভাগের ছোট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিবাদ করলেও ঠিকাদারের লোকজন কোন তোয়াক্কাই করছে না। সড়কের যেসব স্থানে আরসিসি ঢালাই দেওয়ার কথা তাও কৌশলে বেশকটি পয়েন্ট এড়িয়ে গিয়ে গতানুগতিক কার্পেটিং করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। যেসব স্থানে কালভাট (ব্রীজ) দেওয়ার কথা সেখানেও ব্যবহার করা হচ্ছে নিন্মমানের সামগ্রী। ফলে নির্মাণাধীন ব্রীজের স্থায়ীত্ব নিয়েও সন্ধিহান রয়েছে।
বন্যা কবলিত এলাকা হওয়ায় সড়ক সম্প্রসার, বালি ও মাটি দিয়ে সড়ক উচুঁ করে টেকসই সড়ক নির্মাণের পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হলেও কাজের মান নিয়ে সওজ কর্মচারী ও স্থানীয়দের দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিন্মমানের কাজ করে কোন রকমে কাজ সমাপ্ত করার পরিকল্পনায় রয়েছেন।
এছাড়াও সড়কে মাটি, বালু ও ইট সরবরাহে পৃথক পৃথক ঠিকাদার নিয়োগের নিয়ম থাকলেও মূল ঠিকাদার তা না করে নিজেরাই মাতামুহুরী নদীতে সেলু মিশিং বসিয়ে অনুমোদন বিহীন নিয়মবর্হিভূতভাবে সড়কে ময়লা ও কাধাযুক্ত বালু দিয়ে সড়ক ভরাট করছে।
অন্যদিকে সুরাজপুর-মানিকপুর এবং ইয়াংছার পাহাড়ী জনপথ থেকে নিজেরাই পরিবেশ আইন লঙ্গন করে প্রকাশ্য দিবালোকে পাহাড় কেটে সড়কে মাটি দিচ্ছে। অথচ: প্রকল্প সিডিউলে সে ধরণের কোন নিয়মই নেই।
চকরিয়া সড়ক বিভাগের কয়েকজন কর্মচারী চকরিয়া নিউজকে বলেন, নির্মানাধীন সড়কের গাইড ওয়াল,কালভার্ট ও সড়ক নির্মাাণকাজ সিডিউল বহির্ভূত কাজ করা হচ্ছে। নিম্নমানের ইট-বালি ব্যবহার করায় নির্মাণকাজে তদারকিতে নিয়োজিত সওজের কর্মচারী দীন মোহাম্মদ বাঁধা দেয়ায় তাকে মারধরসহ প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
এরপরও করোনা সংক্রমণের সুযোগে গোপনে নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখার বিষয়টি জানতে পেরে চকরিয়া সওজের উপ-সহকারি প্রকৌশলীসহ অফিসের অপরাপর কর্মকর্তা-কর্মচারী সরেজমিনে গিয়ে গাইড ওয়াল নির্মানকাজে নিম্নমানের ইট ব্যবহার না করার জন্য বলে সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ করে দেন।
পরবর্তীতে ঘটনাটি কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীকে লিখিতভাবে অবহিতও করেন। তিনি (নির্বাহী প্রকৌশলী) সম্প্রতি সরে জমিনে তদন্তে এসে এর সত্যতাও পান। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক আবীর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, চকরিয়া সড়ক বিভাগের কিছু কর্মচারী পছন্দের ইটভাটা থেকে ইট কিনতে আমাকে চাপ প্রয়োগ করেন। হুমকির বিষয়টি অবান্তর।
জানতে চাইলে কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু কুমার চাকমা বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক এবং আমার অফিসের লোকজনের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝির ঘটনা ঘটে এটি সত্য। কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত উভয়পক্ষ এধরণের বিবাদে জড়ালে নির্মাণ কাজের চরম ক্ষতি হবে। এতে জনগনের দুর্ভোগ বাড়বে। তাই সবাইকে নিয়ে স্বচ্ছতার মাধ্যমে কাজটি সমাপ্ত করতে আমরা চেষ্ঠা চালাচ্ছি। সেখানে কোন ধরণের অনিয়ম হলে অবশ্যই বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে ১৭ কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা ও সুরাজপুর-মানিকপুরসহ পাঁচটি ইউনিয়নের জায়গা পড়েছে। এসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমনের আগে অর্থাৎ তিনমাস আগে পুরো সড়কটি একসঙ্গে খুলে ফেলার কারণে বর্তমান বর্ষাকালে কাদাযুক্ত সড়কে সবধরণের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এমনকি পায়ে হেটে যেতেও জনসাধারণকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পাশাপাশি নিন্মমানের কাজের কারণে বর্তমানে সমাপ্ত হওয়া কিছু এলাকায় কাজের অনেক অংশে ভেঙ্গে যাচ্ছে। এতে জনদুর্ভোগ আরো বাড়ছে।
সড়ক নির্মাণকাজে নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহারের সত্যতাসহ অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আলহাজ ফজলুল করিম সাঈদী।
তিনি বলেন, সড়ক নির্মাণ কাজে নিন্মমানের উপকরণ ব্যবহারের কারণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় সমাপ্ত হওয়া নির্মাণ কাজের অংশ ভেঙ্গে যাচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার ১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। সরকারের এত পরিমাণ টাকা নিম্ন মানের কাজের মাধ্যমে পানিতে যাবে তা কোনভাবে মেনে নেয়া যাবে না। বিষয়টির আলোকে উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সভায় সিদ্বান্ত নেয়া হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উর্ধ্বতন প্রশাসনকে জানানো হবে।
পাঠকের মতামত: